দেশে শিশুশ্রম কমেনি

প্রকাশিতঃ 10:31 pm | December 19, 2024

কালের আলো রিপোর্ট:

দেশে গত এক যুগে শিশুশ্রম কমেনি, বরং বেড়েছে। মোটর গ্যারেজ, লেদ মেশিন, বর্জ্য অপসারণ, ভাঙারি দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ ইত্যাদিসহ নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যায় শিশুদের। দিন দিন দেশে শিশুশ্রমিক আরও বাড়ছে। কোনও মতে খেয়ে পরে বাঁচতে পারলেই তারা খুশি। কিন্তু অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সব ধরণের মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত থাকায় তারা দুর্বিসহ জীবন যাপন করে। এই দেশের শহরাঞ্চলের শিশুরা প্রায় ৩০০ ধরনের অর্থনৈতিক কাজে জড়িত। ব্যাপক দারিদ্র্য, জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট দুরবস্থা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, শিশুশ্রমের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব, স্বল্প বেতনে শিশু শ্রমিকের সহজ প্রাপ্তি, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, পারিবারিক জটিলতা, বাবা-মায়ের সম্পর্কের বিচ্ছেদ, সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির স্থায়ী অনুপস্থিতি, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি, বাবা-মা’র পেশা, শহরে বস্তির বিস্তার ইত্যাদি শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে দেখেছে ইউনিসেফ।

বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর বনানী গোল্ডেন টিউলিপ হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে- বর্তমানে দেশে শিশু শ্রমে যুক্ত রয়েছে ৪.৪ শতাংশ শিশু। তাদের মধ্যে ১২ থেকে ১০ বছরের শিশু রয়েছে ৯ শতাংশের বেশি। এছাড়াও এসব শিশুদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৭ বছরের ৭.৯ শতাংশ শিশুরাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত আছে। এমনকি এসব শিশুদের মধ্যে ছেলে শিশু মেয়েদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি শ্রমে নিযুক্ত হয়। শিশুশ্রমে যুক্ত এসব শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে ৬ গুণ বেড়েছে। এডুকো বাংলাদেশের শিশু অধিকার ও কল্যাণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের মূল তথ্য উপস্থাপন করেন ইনস্পিরা অ্যাডভাইজরি অ্যান্ড কনসাল্টিং লিমিটেডের পোর্টফোলিও ম্যানেজার মোহাম্মদ আদনান রহমান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পথশিশুদের মধ্যে প্রায় ৩৮ শতাংশ শিশুই পরিবারের মাধ্যমে শ্রমে যুক্ত হয়, যারা দিনে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বা সপ্তাহে ১ হাজার টাকার মতো উপার্জন করে। এমনকি শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের মধ্যে স্কুলে না যাওয়ার সম্ভাবনা ৬ গুণ বেশি দেখা গেছে।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাল্যবিবাহ এখনও মারাত্মক আকারে প্রচলিত রয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়। এতে দেখা গেছে, এখনও ৪৯.৬ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে করেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৪০.৯ শতাংশ। এমনকি তাদের মধ্যে ৮.২ শতাংশ মেয়েই ১৫ বছরের আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রথা, পরিবারের সম্মান, শিক্ষার অভাব, এবং জাল কাগজপত্রের সাহায্যে গোপন বিয়ের সুযোগ হলো বাল্য বিয়ের মূল কারণগুলোর অন্যতম।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৪.৬ শতাংশ শিশু অভিভাবকদের কাছ থেকে হালকা ও গুরুতর শাস্তির শিকার হয়, যা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবেও দেখা যায়। বিশেষ করে এসব শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ ও আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের শিশু আইন গুরুতর শাস্তি নিষিদ্ধ করলেও হালকা চোটের শান্তি অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০১১ সালের উচ্চ আদালতের আদেশে স্কুলে শান্তি কমলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানসিক সংযোগ কম এবং পরামর্শের সুযোগ নেই।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে কিশোরদের মধ্যে মাদকাসক্তির পরিমাণ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০২২ সালেই দেশের বিভিন্ন থানায় ৯২ হাজার ৯০৯টি মাদক উদ্ধারের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। গবেষণা বলছে, পথশিশুদের অর্ধেক মাদক সরবরাহ চেইনে যুক্ত এবং ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি মাদক গ্রহণ করে। মাদকাসক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত, যা চুরি, হয়রানি, এবং নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগ বাড়ায়। প্রতি ৬ জন শিশুর মধ্যে ৩ জন সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে দেখা গেছে, সেকেন্ডারি স্কুলে ছাত্র- ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকদের মানসিক সম্পৃক্ততা অনেক কম। যার কারণে ছাত্রছাত্রীরা এ বয়সের সমস্যাগুলো তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলে যায় না, যা কুসংস্কার, অবকাঠামোগত ঘাটতি এবং অভিভাবকদের অজ্ঞতার কারণে ঘটে। যারা স্কুলে ভর্তি হয়, তারা হয়রানি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হয় এবং সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব একটি মূল ভূমিকা পালন করে, যা তাদের ঝরে পরার হারকে বাড়িয়ে দেয়। তাদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণের জন্য বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় মোহাম্মদ আদনান রহমান শিক্ষার গুণগতমান, সুরক্ষা এবং কল্যাণসহ শিশুদের মুখোমুখি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। প্রতিবেদনটি শিশুদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বহুখাত ভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ বেগম। এসময় তিনি বলেন, শিশুদের সুরক্ষায় সবসময় তার পরিবারকেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং যে কোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। আমরা সময় সময় সন্তানদের জন্য নিকটাত্মীয়দের খুবই ভরসা করে থাকি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যে কোনো বিপদ কিন্তু সবসময় খুব সেফ জোন থেকেই বেশি আসে।

তিনি বলেন, বাবা মা হিসেবে শিশু কার সঙ্গে কতটুকু মেলামেশা করবে, তা পরিবার থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ সীমার বিষয়টি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকেও সচেতনতাবোধের বিষয়টি শিক্ষা নিতে পারি। মমতাজ বেগম বলেন, এনজিওগুলো সরকারের আয়নার মতো, যা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানায়। আমি এই প্রতিবেদনের ফলাফল এবং সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এডুকো এবং ইনস্পিরাকে ধন্যবাদ জানাই এই কাজের জন্য।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, শিশুদের সুরক্ষা পরিবার থেকেই নিশ্চিত করতে হবে, কারণ শিশুরা পরিবারের ভেতরেও ঝুঁকিতে থাকে। তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আরজু আরা বেগম এডুকো ও ইনস্পিরাকে এই উদ্যোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খুঁজে বের করার জন্য ধন্যবাদ জানান। এসময় অনুষ্ঠানটির সমাপনী বক্তব্য রাখেন এডুকো বাংলাদেশের পলিসি ও অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার হালিমা আক্তার। তিনি শিশুদের কল্যাণে একটি পৃথক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের প্রণয়নের দাবি জানান।

কালের আলো/আরআই/এমকে