হুমগুটি খেলায় লাখো মানুষের ঢল 

প্রকাশিতঃ 8:41 pm | January 14, 2025

ময়মনসিংহ প্রতিবেদক, কালের আলো:

পৌষ মাসের শেষ দিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘পুহুরা’। হুমগুটি খেলাটি অনেকের অজানা হলেও ময়মনসিংহবাসীর কাছে খুবই পরিচিত এক নাম। ৪০ কেজি ওজনের পিতলের তৈরি বলের মতো দেখতে একটি বস্তুর নাম ‘গুটি’। এটি দিয়েই হয় হুমগুটি খেলা। এই খেলায় নেই কোনো নিয়ম কানুন, থাকেনা কোনো রেফারি কিংবা বিচারক। খেলোয়াড়েরও কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। গুটি টানাটানিই হলো খেলা। টেনে হিঁচড়ে কাড়াকাড়ি করে যে বা যারা এই গুটি গুম করে ফেলতে পারবে তারাই বিজয়ী।

২৬৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘হুমগুটি’ খেলায় আবারও চিরচেনা এমন দৃশ্যই নজর কেড়েছে। এবারও সেখানে জমায়েত হয়েছিলো হাজার হাজার মানুষ। হুমগুটি খেলায় অংশ নিতে মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকেই ফুলবাড়িয়ার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা বন্দে মানুষজন আসতে শুরু করেন। বিকেলে খেলা শুরুর আগেই খেলাস্থল পরিণত হয় জনসমুদ্রে। এই দিনে একই সময়ে একই স্থানে যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই হুমগুটি খেলা।

জানা যায়, এলাকাভিত্তিক একেকটি দলে শতশত খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণে চলে গুটি দখলের শক্তির লড়াই। এই খেলাকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীপুর, দেওখোলাসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে চলে উৎসবের আমেজ। এদিকে হুমগুটি খেলাকে ঘিরে বসা গ্রামীণ মেলায় শিশুদের খেলনা ও খাবারের দোকানেও ছিল উপচেপড়া ভিড়। খেলা দেখতে সপরিবারে এসেছিলেন অনেকে।

স্থানীয়রা জানায়, ১৭৫৮ সালে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশিকান্তের সঙ্গে ত্রিশাল উপজেলার বৈলরের হেমচন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে। পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূখণ্ডে দুই নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রতিবাদী আন্দোলন। জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এ গুটি খেলার আয়োজন করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’।

জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। এভাবেই তালুক পরগনার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ব্রিটিশ আমলে জমিদারী এই খেলার গোড়াপত্তন। জমিদার ও জমিদারি প্রথা না থাকলেও সেই হুমগুটি খেলাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এলাকাবাসী। খেলায় মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ সদর ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে দল বেঁধে শতশত খেলোয়াড় ও উৎসুক জনতা আসে খেলাটি দেখতে।

এ খেলায় একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে। ওই নিশানা দেখে বোঝা যায় কারা কোন পক্ষের লোক। ‘গুটি’ কোন দিকে যাচ্ছে তা মূলত চিহ্নিত করা হয় নিশানা দেখেই। নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় খেলায়। এভাবে গুটি ‘গুম’ না হওয়া পর্যন্ত চলে খেলা। স্থানীয় আব্দুল হামিদ (২৪) জানান, ‘জমিদার আমল থেকে হুমগুটি খেলা হয়ে আসছে। বংশপরম্পরায় আমার পূর্বপুরুষরা ঐতিহ্যবাহী খেলাটির আয়োজন করেছে। এখন আমরা করছি, এরপর পরবর্তী প্রজন্ম করবে। এভাবে যুগযুগ চলতেই থাকবে।’

কালের আলো/এমডিএইচ