মুখচ্ছবি নয়, ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে এনআইডির দাবিতে আলটিমেটাম
প্রকাশিতঃ 5:18 pm | January 15, 2025
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:
‘মুখচ্ছবি নয়, ফিঙ্গার প্রিন্টের ভিত্তিতে পর্দানশীন নারীদের এনআইডি প্রাপ্তির দাবিতে’ নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে কর্মসূচি পালন করেছেন রাজারবাগ দরবার শরীফের মহিলা আনজুমানের সদস্যরা।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কমিশনের সামনের সড়কে এই কর্মসূচি পালন করেন তারা।
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা অভিযোগ করেন, ১৬ বছর ধরে পর্দানশীন নারীদের এনআইডি বঞ্চিত করে মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে মহিলা আনজুমানের সদস্য এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়ে তাদের ধর্মীয় অধিকার এবং প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুণ্ন রেখে এনআইডি’র দাবি জানান। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দাবি না মানলে এর পক্ষে দেশব্যাপী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মাঠে নামবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
মহিলা আনজুমানের প্রতিনিধিরা বলেন, একজন নারী ছবি তুললে দুটি গুনাহ হয়। একটি ছবি তোলার গুনাহ, অন্যটি বেপর্দা হওয়ার গুনাহ। আমরা পর্দানশীন নারীরা সেই গুনাহ থেকে বাঁচতে চাই। ইসি কর্মকর্তারা আমাদের নাগরিকত্ব আটকে রেখে সে গুনাহ করতে বাধ্য করতে পারে না।
মহিলা আনজুমানের প্রতিনিধিরা আরও বলেন, আমি আমার চেহারা কাউকে দেখাব না, এটা আমার গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির অধিকার। অর্থাৎ পর্দানশীন নারীদের আজকের এই দাবি শুধু ধর্মীয় অধিকারের মধ্য পড়ে না, প্রাইভেসির অধিকারের মধ্যেও পড়ে। ফলে দুই দিক থেকেই পর্দানশীন নারীদের দাবি মানবাধিকার ও সংবিধানিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
মহিলা আনজুমানের প্রতিনিধিরা আরও বলেন, এনআইডি ছাড়া পর্দানশীন নারীরা মৌলিক ও নাগরিক অধিকার হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেক পর্দানশীন নারী অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, কিন্তু এনআইডি ছাড়া ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ সম্পত্তি বিক্রি করতে পারলে তিনি চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারতেন। অনেক পর্দানশীন নারীর দুর্ঘটনায় বাড়িঘর আগুনে পুড়ে গেছে। এনআইডির ছাড়া ত্রাণ নিতে পারছেন না। অনেক বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা পর্দানশীন নারী এনআইডির অভাবে বাসা ভাড়া করতে পারছেন না, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। পর্দার সঙ্গে কোনো চাকরি করে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন না। গত ১৬ বছর ধরে পর্দানশীন নারীদের সাবেক ইসি কর্মকর্তারা যে কষ্ট দিয়েছে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।
তারা আরও বলেন, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। গত ১৬ বছর শুধুমাত্র পরিপূর্ণ পর্দা করার কারণে নারীদের সঙ্গে যে বৈষম্য হয়েছে, আমরা এ বৈষম্যের পরিসমাপ্তি চাই। অবিলম্বে পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুন্ন রেখে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে হবে।
তারা আরও বলেন, এনআইডির মুখচ্ছবি পরিবর্তনযোগ্য। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মুখচ্ছবি পরিচয় যাচাইয়ের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়। অথচ সেই মুখচ্ছবির অজুহাতেই পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া ছবি দিয়ে সনাক্তকরণ দুর্নীতিবান্ধব পদ্ধতি, অপরদিকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সনাক্তকরণ দুর্নীতিরোধক পদ্ধতি। যেমন আগে ব্যাংকগুলোতে ছবি দেখে পরিচয় যাচাইয়ে এক ব্যক্তির একাধিক পরিচয়ে ঋণ উত্তোলনের মতো প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এ প্রতারণা রুখতে বর্তমানে ব্যাংক ঋণ উত্তোলনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার ছবি দেখে পরিচয় যাচাইয়ে একজন ব্যক্তির একাধিক এনআইডি তৈরির মতো ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে দ্বৈত এনআইডির সমস্যাও দূর হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে। আবার একটা সময় বাংলাদেশিদের সঙ্গে চেহারার মিলকে পুঁজি করে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি জমায়, কিন্তু যখনই তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে যাচাই শুরু হয়, তখনই রোহিঙ্গাদের প্রতারণা ধরা পড়ে এবং সমস্যার সমাধান হয়। আবার দেখা যায়, অপরাধীরা বার বার রূপ বদলানোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চেহারার ছবি দেখে তাদের ধরা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। অনেক সময় চেহারার মিল থাকায় নিরাপরাধ ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে ধরে পরে যায়। এই সমস্যা সমাধানে আইনশৃঙ্লাবাহিনী অপরাধী সনাক্তে ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তির আশ্রয় নিচ্ছেন। যেমন- এলিট ফোর্স র্যাব ফিঙ্গারপ্রিন্টের OIVS প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, পুলিশের সিআইডি ফিঙ্গারপ্রিন্টের AFIS প্রযু্ক্তি ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ নির্ভুল যাচাইয়ের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট এখন সর্বাধুনিক ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যম।
উল্লেখ্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে ছবির অপব্যবহার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এক ছবি একাধিক লোক ব্যবহারের প্রযুক্তিও আবিষ্কার হয়েছে। এসব কারণে আধুনিক বিশ্ব মুখচ্ছবি দেখে পরিচয় যাচাই বর্জন করেছে।
মহিলা আনজুমানের প্রতিনিধিরা বলেন, পর্দানশীন মহিলাদের এনআইডি দিতে আইনেও কোনো বাধা নেই। বিশেষ করে পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ এবং ২০২৩-এ পরিচয় সনাক্তে চেহারার ছবির কথা উল্লেখ নাই। এমনকি বায়োমেট্রিক যাচাইয়ে ফেসিয়াল রিকগনিশনকেও বাধ্যতামূলক করা হয়নি। কিন্তু তারপরও স্বৈরাচারী মনোভাব থেকেই পর্দানশীন নারীদের নাগরিকত্ব বঞ্চিত করে রেখেছিল সাবেক ইসি কর্মকর্তারা। পর্দানশীন নারীরা চান নতুন ইসি কর্মকর্তারা আর সেই পথে না হাঁটুক। পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুণ্ন রেখেই অবিলম্বে তাদের এনআইডি প্রদান করুক।
পরে মহিলা আনজুমানের প্রতিনিধিরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিতে তিনটি দাবি তুলে ধরেন।
১. বিগত ১৬ বছর ধরে পর্দানশীন নারীদের মানবাধিকার হরণ করা ইসি কর্মকর্তাদের বিচার।
২. পর্দানশীন নারীদের ধর্মীয় ও প্রাইভেসির অধিকার অক্ষুন্ন রেখেই এনআইডি প্রদান।
৩. পর্দানশীন নারীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ায় মহিলা অফিস সহকারী বাধ্যতামূলক করা।
কালের আলো/এমডিএইচ