জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলানে দিশেহারা মধ্যবিত্ত
প্রকাশিতঃ 9:34 am | January 18, 2025
কালের আলো রিপোর্ট:
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে জাকির হোসেন। ২০২২ সালে বেতন পেতেন ৪০ হাজার টাকা। রাজধানীতে তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে বাস তাঁর। বাজারের খরচ, বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনাসহ কষ্টেসৃষ্টে সংসারের খরচ চলে যায় তাঁর। মাঝেমধ্যে টুকটাক সঞ্চয়ও করেন। কিন্তু গত তিন বছরে তাঁর বেতন বেড়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। ৫০ হাজার টাকায় এখন আর তাঁর সংসার চলে না বললেই চলে। কারণ, এই সময়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
শুধু জাকিরই নন, এমন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তাদের এখন সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই জীবনযাত্রার ব্যয় সংকুলানে এসব মানুষ এখন দিশেহারা। ক’দিন আগে সরকার নতুন করে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এটি যেন তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। জীবনযাত্রার আরেক দফা খরচ বাড়ার আশঙ্কায় সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের আক্ষেপের শেষ নেই। মূল্যস্ফীতির তাঁরা কোন অবস্থাতেই কুলিয়ে ওঠতে পারছেন না।
প্রায় তিন বছর ধরে চলতে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্বস্তিতে নেই ভোক্তারা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গেল বছর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি। উল্টো বেড়েছে বেকারের সংখ্যা। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৬০ হাজার, যা এক বছর আগে ওই সময়ে ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারির পর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি মজুরি বৃদ্ধির হার। প্রতি মাসে গড়ে যত মজুরি বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের বাজার থেকে নিত্যপণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য কমেছে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান একটি গণমাধ্যমকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দু-তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বাজার থেকে পণ্য কেনার সামর্থ্য কমেছে। ফলে সংসার খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরির হার কম হলে দারিদ্র্যসীমার ওপরে মোট জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ মানুষ অতিঝুঁকিতে থাকে। সেই হিসাবে দেড় কোটি মানুষ বছরজুড়ে এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে।
২০২৩ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কিন্তু ওই বছর মজুরি বৃদ্ধির হার কোনো মাসেই ৮ শতাংশ ছাড়ায়নি। ৭ শতাংশের মধ্যেই তা আটকে ছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ১২ মাসের মধ্যে প্রথম আট মাস মজুরি বৃদ্ধি হার ছিল ৭ শতাংশের ঘরে। শেষ চার মাস ৮ শতাংশের ওপরে ছিল এই হার। মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ পড়ে বেশি। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর এই হিসাব করে থাকে বিবিএস। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির মতো।
অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি আগের সরকার। তা ছাড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে বাজার ব্যবস্থাপনা ছিল নাজুক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মুদ্রানীতি সংকোচন করার পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মসংস্থান কমেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি কমিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করতে পারেনি। এসব ক্ষেত্রে অনেকটা আত্মসমর্পণ করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। মাস কয়েক আগে তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে বলেন, তেল ও চিনি ব্যবসায়ীরা অনেক শক্তিশালী। তা ছাড়া বিভিন্ন সময় তিনি বলেন, অতিরিক্ত চাঁদাবাজির কারণেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে