জনআস্থা ফেরাতেই মনোযোগ আইজিপির, একাত্ম করতে চান জনগণের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে নিজেদের

প্রকাশিতঃ 10:31 pm | January 23, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

পতিত সরকারের নির্দেশ মানতে গিয়ে গণশত্রুতে পরিণত হয় পুলিশ। জনরোষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে বাহিনীটি। ক্ষোভের বলি হয়ে প্রাণ যায় অনেক পুলিশ সদস্যের। জুলাই বিপ্লবের অভিঘাতে তছনছ হয়ে যায় পুরো পুলিশী ব্যবস্থা। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নেওয়ার পর দু’দফা পরিবর্তন এসেছে পুলিশের শীর্ষ আইজিপি পদটিতে। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নিজ বাহিনীটিকে ঢেলে সাজানোর কাজে হাত দেন বাহারুল আলম। পুলিশের অভিজ্ঞ এই সর্বোচ্চ কর্মকর্তা আতঙ্ক-ভীতি কাটিয়ে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাহিনীটির সদস্যদের মনোবল ফেরানো, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিষ্ক্রিয়তা ভেঙে সক্রিয় করা, সব রকমের ‘অনিশ্চয়তা’ দূরে ঠেলে আধুনিক জনবান্ধব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশকে রূপ দিতে জনআস্থা ফেরানোর নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। পরিবর্তন হতে যাচ্ছে পুলিশের ইউনিফর্ম। পুলিশ সংস্কার কমিশন সপ্তাহখানেক আগে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাহিনীটিকে স্বরূপে ফেরাতে পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিপর্যস্ত এক অবস্থা থেকে দৃশ্যমান উন্নতি সাধনের সব প্রচেষ্টাই অব্যাহত রেখেছেন আইজিপি বাহারুল আলম। মনিটরিং ও তদন্তে মান বাড়াতে ঊর্ধ্বতন এবং অভিজ্ঞ, যারা বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে গেছেন তাদেরকে নিয়ে মনিটরিং টিম করেছেন। সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি গঠন করেছেন। এখনও পুরোপুরি সব গুছিয়ে ওঠতে না পারলেও আইনশৃঙ্খলার রক্ষক হিসেবে পুলিশকে জনগণের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হতে উজ্জীবিত করছেন প্রতিনিয়ত।

নবীন কর্মকর্তাদেরও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তিনি মনে করেন, পুলিশ জনগণের আস্থাভাজন হলে তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করবে। বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে পুলিশ সদর দপ্তরে ৪৩তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) ওরিয়েন্টেশন কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে তাঁর বক্তব্যেও প্রতিফলিত হয়েছে আত্মবিশ্বাস ও উদ্যমী হয়ে পুলিশকে ‘জনগণের প্রকৃত বন্ধু’ হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতেই তাঁর দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকার বিষয়টিও।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ‘পুলিশকে পুলিশের মতো’ গড়ে তোলা হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার দলীয় স্বার্থে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। দলের প্রয়োজনে পুলিশকে নিজেদের লাঠিয়াল হিসেবে রূপান্তরিত করেছে। অথচ পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশে আইনের শাসন জারি রাখতে হলে পুলিশকে অবশ্যই নীতি-নৈতিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। এ জন্য পুলিশকে রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত হতে হবে, যাতে কেউ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে না পারে। জনগণ বাধ্য হয়েই পুলিশের কাছে যান, কিন্তু যে সাহায্যের আশায় পুলিশের কাছে যান, পুলিশ যদি সেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেয়, তখন পুলিশের প্রতি মানুষের আর আস্থা থাকে না। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, তাতে দিনে দিনে পুলিশের ওপর জনগণ আস্থা হারিয়েছে।

পুলিশি কার্যক্রমে গতি ফেরাতে পুলিশের ওপর মানুষের আস্থার সংকটকে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তাঁরা বলছেন, ১৫ বছর ধরে পুলিশকে দলীয় পেটোয়া বাহিনীর মতো ব্যবহার করেছে শেখ হাসিনা সরকার। সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও মানুষের মনে পুলিশ সম্পর্কে এখনো নেতিবাচক ধারণা রয়ে গেছে। অনেকে এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তারেরও চেষ্টা করছেন। কারও কারও মধ্যে পুলিশের বৈধ নির্দেশনা না মানার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। পুলিশকে এক প্রকার জিম্মি করে কোথাও কোথাও নিরপরাধকে মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের পুলিশ নিয়ে প্রত্যাশা বোঝার জন্য সংস্কার কমিশনের ‘কেমন পুলিশ চাই’ জনমত জরিপের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে- মতামত প্রদানকারীরা সবচেয়ে বেশি দেখতে চেয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আইনের প্রতি অনুগত বা নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ। পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান চেয়েছেন ৮৯.৫ শতাংশ উত্তরদাতা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি বন্ধ চেয়েছেন ৭৭.৯ শতাংশ উত্তরদাতা। ৭৮.৯ শতাংশ উত্তরদাতা গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে অপরাধী পুলিশের জবাবদিহি এবং শাস্তি চেয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, পুলিশে জনআস্থা ফেরানোর সব চেষ্টাই করা হচ্ছে। বিতর্কিত ও পতিত আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের সরানো হয়েছে, মামলায় অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। বিটপুলিশিং চাঙ্গা ও জনগণের দোরগোড়ায় দৌড়াচ্ছে পুলিশ। জনগণের অভিযোগ, সমস্যা শুনতে চেষ্টা করছে পুলিশ। এরই মধ্যে ডিএমপিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মতবিনিময় সভার আয়োজন করছে।

আইজিপি বাহারুল আলম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে এতগুলো মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন এশিয়ার ইতিহাসেও এমন নজির নেই। এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পরও আমাদের সক্ষমতায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোকটা দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা চলমান। বদলি হচ্ছে। তদন্ত করতে পারে সেরকম সক্ষম লোকদের বাছাই করে এ কাজে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া, সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি করেছি।

পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম একাধিকবার বলেছেন, তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পুলিশের মনোবল ফেরানো। পুলিশ যাতে জনগণের কাছে যায়, জনগণের সমস্যা বা অভিযোগ শোনে, সে অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। পুলিশ সব সময় জনগণের বন্ধু। সমাজটাকে ভালো রাখতে পুলিশের বিকল্প নেই। তাই সবাইকে দোষারোপ করে অপরাধীর কাতারে নেওয়া ঠিক নয়। যারা অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পুলিশে যারা নিরপরাধ, তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। পুলিশ দেশের ও জনগণের জন্য অপরিহার্য। এই বাহিনী ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা অসম্ভব। পুলিশকে জনগণের রক্ষক হতে যা যা করা দরকার, সব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

পুলিশ সদর দপ্তরে ৪৩তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচের সহকারী পুলিশ সুপারদের (এএসপি) ওরিয়েন্টেশন কোর্সের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইজিপি নবীন কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা ভবিষ্যৎ পুলিশ নেতৃত্ব। আপনাদের ওপর পুলিশ বাহিনীর মর্যাদা নির্ভর করে। তাই আপনাদেরকে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে অন্যদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে।’

তিনি বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পুলিশের কাছে জনগণের প্রত্যাশা নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলার রক্ষক হিসেবে পুলিশকে জনগণের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ পুলিশিং একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা উল্লেখ করে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, ‘আপনাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আপনাদেরকে সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার এবং নতুন নতুন আইন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সর্বশেষ প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট থাকতে হবে।’ পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ৪৩তম বিসিএস (পুলিশ) ব্যাচে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে ৮৪ জন কর্মকর্তা যোগদান করেছেন। তাদের মধ্যে ৭৮ জন পুরুষ এবং ছয় জন নারী।

কালের আলো/এমএএএমকে