ক্ষমতা বাড়বে রাষ্ট্রপতির কমবে প্রধানমন্ত্রীর
প্রকাশিতঃ 9:49 am | January 28, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
আর থাকছে না প্রধানমন্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতা। বাড়ছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা। প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতাও হারাবেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে দলীয়প্রধান ও সংসদ নেতা হতে না পারলে ক্ষমতাসীন দল এবং সংসদে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হারাবেন প্রধানমন্ত্রী।
ইতোমধ্যেই সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রশ্নে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এবং অংশীজনদের অবশ্য এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে কীভাবে সেই ক্ষমতার ভারসাম্য আনা যাবে এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এই সংলাপ অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সেখানে আলোচনার মাধ্যমে উপায় বের করার প্রচেষ্টা থাকবে।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয় বাংলাদেশে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা চালু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ- আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন হলে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা চলে যায় প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া কিছুই রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলতে হয়। ৫৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদীয় দলের সমর্থিত নেতাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতি বাধ্য।
এখন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। সংবিধানের এই জায়গায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কিছু সাংবিধানিক পদে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার কথা বলেছে তারা। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না। গত ১৫ জানুয়ারি নিজেদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা সুপারিশ করছে। এই বিশেষ কার্যাবলি বা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদনে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ চলছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়বে। কমবে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা।
জানা যায়, ৬৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। এ পদের মেয়াদ রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে। ১৩৮ (১) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্ম-কমিশনের (পিএসসি) সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যদের, ১২৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। স্পিকারের নেতৃত্বাধীন বাছাই কমিটির মাধ্যমে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। বাছাই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আইনমন্ত্রী এবং সরকারের বিভিন্ন কমিশন এবং সংস্থার কর্মকর্তারা। ফলে এসব নিয়োগও হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়।
তা রোধে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এতে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত ৯ সদস্যের কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত দুই কক্ষের ডেপুটি স্পিকার, সংসদের অন্যান্য দল থেকে একজন সদস্য। এনসিসির পাঠানো নাম থেকে নির্বাচন কমিশনার, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।
২০১৮ সালে প্রণীত ‘প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহের প্রধানদের নিয়োগ’ আইনানুযায়ী সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে এসব নিয়োগও আসলে হয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। সশস্ত্র বাহিনীতে প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান প্রস্তাবিত এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। অন্যান্য নিয়োগেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে এনসিসির সুপারিশে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য বিভাগ নির্বাহীর অধীনে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান। তাঁর হাতে নির্বাহী বিভাগের নিয়োগের ক্ষমতা না থাকলে কীভাবে সরকার পরিচালনা করবেন– এ প্রশ্নে কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, এগুলো শুধু সুপারিশ। সাংবিধানিক পদে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী একচ্ছত্র না থাকলেও নির্বাহী বিভাগে থাকবে।
বিএনপির ৩১ দফায় ক্ষমতার ভারসাম্য তথা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীকে একেবারেই ক্ষমতাহীন করাকে সমর্থন করছে না দলটি। তবে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতা কমানোর পক্ষে। দল দুটির নেতারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোন মন্তব্য করেননি। সুপারিশ পর্যালোচনা ছাড়া তাঁরা কোন কথা বলতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেভাবে সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে আপাতদৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে কতটা কাজ করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় থাকে। কারণ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির কথা বলেছে, সেটা বাস্তবায়িত হলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত প্রার্থীই যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন, তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
কালের আলো/এমএসএকে/এমকে