দাবি আদায়ের নগরী ঢাকা, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ রাজধানীবাসী
প্রকাশিতঃ 10:16 am | January 31, 2025
কালের আলো রিপোর্ট:
দাবি আদায়ে রাজধানীতে সড়ক অবরোধ এখন নৈমিত্তিক বিষয়। প্রতিনিয়ত স্থবির হয়ে পড়ছে ঢাকা। দিন যাচ্ছে আর বাড়ছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। কখনও কখনও ঘটছে ভাঙচুর-সহিংসতা। এগুলো কী শুধুমাত্রই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না কী পূর্ব পরিকল্পিত? সবকিছুর মধ্যেই যেন ঢাকাকে অচল করে দেওয়ার চক্রান্ত। দাবি আদায়ে রাজপথকেই বেছে নেওয়াকে যারা সমাধান দেখছেন তাঁরা ভেবেও দেখছেন না কী অসহনীয় ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে জনজীবনকে। আলোচনার দুয়ার সরকার খুলে রাখলেও দাবি আদায়ের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজধানীকে।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারির) কথাই ধরা যাক। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করাসহ সাত দফা দাবিতে সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান নেওয়ার কারণে সকাল ১১টা থেকে কলেজের সামনের সড়কের দুই পাশে (আমতলী থেকে গুলশান ১ এবং গুলশান ১ থেকে আমতলী) যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে আমতলীসহ আশপাশের সড়কগুলোতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় পথচলতি মানুষদের। এদেরই একজন শফিউল আলম। থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। জরুরি প্রয়োজনে এসেছিলেন গুলশানে। ভাঙা হাত নিয়ে চলাচলেও ভীষণ কষ্ট। কিন্তু সড়ক অবরোধের মুখে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা। গজর গজর ভঙ্গিতে তিনি বলছিলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ পথে আটকা পড়েছেন।’ এই ব্যক্তি প্রশ্ন রাখেন দু’টি। পাবলিকের দোষ কোথায়? আর দাবি দাওয়ার কারণে কেন মূল্য দিতে হবে সাধারণ মানুষকে? কিন্তু কে উত্তর দিবে তাঁর প্রশ্নের।
জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলন হয়ে উঠেছে নিত্যদিনের চিত্র। সাড়ে ৫ মাসের অধিক সময়ে সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষ বা হতাহতের ঘটনাও কম ঘটেনি। মাঝখানে কিছুটা বিরতি থাকলেও সম্প্রতি পুনরায় ঘন ঘন অবরোধের ঘটনা ঘটছে। নেতিবাচক এই প্রভাবে বিপর্যস্ত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ রাজধানীবাসী। সরকার শুরু থেকেই যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনের অধিকারকে সমর্থন করলেও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে আন্দোলন না করতে বারবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ইতোমধ্যেই সবার মধ্যে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে রাজপথ অবরোধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে। আদায় করা সম্ভব হবে দাবি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অতীতের মতো চড়াও না হয়ে যথেষ্ট ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিচ্ছে। তাঁরা বেশিরভাগ সময়েই কোন রকম বল প্রয়োগ করেনি। তবে প্রতিটি আন্দোলনে তৃতীয় কোন পক্ষের উস্কানি বা ইন্ধন রয়েছে কীনা এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখার জোর দাবি ওঠেছে।
জানা যায়, চলতি মাসে ইবতেদায়ি মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন ইবতেদায়ি মাদরাসার শিক্ষকেরা। তারা প্রথমদিকে প্রেসক্লাবের সামনে এবং পরে শাহবাগে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন। রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করায় ওই রাস্তায় জনদুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। দাবি আদায় না হওয়ায় তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাতে বাঁধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। পরে বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা হয়। তার পরেই ইবতেদায়ি শিক্ষকদের দাবি মেনে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তারপর তারা রাস্তা ছেড়ে দেন।
মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধা দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিলেন রেলের রানিং স্টাফরা। এই রানিং স্টাফরা হলেন গার্ড, ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার), সহকারী চালক ও টিকিট পরিদর্শক (টিটিই)। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেও তারা সফল হননি। তবে হঠাৎ তারা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে কঠোর অবস্থানে যান। এতে বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। সারাদেশে একযোগে ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ায় নানা সমালোচনা তৈরি হয়। তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টি সমাধান করার জন্য কয়েক দফায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। পুরো একদিন রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর তাদের দাবি মেনে নেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
এই দুই আন্দোলনের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের এক বক্তব্য ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবি অধিভুক্ত থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন। এই সংঘর্ষের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টি সমাধান দিয়েছেন। এ ছাড়াও কিছুদিন আগে পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি চিকিৎসকরা ভাতা বাড়ানোর দাবিতে রাজপথে নামেন। তারাও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড় অবরোধ করে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যান। সেই আন্দোলনের এক পর্যায়ে তাদের দাবিও মেনে নেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। এর মাঝে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এদিকে, বিগত সরকারের আমলে অবৈধভাবে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের পুনর্বহালের দাবিতে তারা আবারও আন্দোলনে নেমেছেন। আজ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তারা একটি পদযাত্রা বের করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে তাদের পদযাত্রাটি সচিবালয়ে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে।
এভাবে প্রতিদিনই নতুন নতুন আন্দোলনে রাজধানীতে রাস্তা অবরোধ হচ্ছে। রাস্তা অবরোধ না করে বিকল্প স্থানে আন্দোলনের করার জন্য জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি শাহবাগে না দাঁড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্দোলন করার জন্য অনুরোধ করেন। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই বক্তব্যে তেমন সাড়া দেননি আন্দোলনকারীরা।
রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এতদিন একপক্ষের লোকেরা সুবিধা নিয়েছে, তাই বঞ্চিতরা দাবি আদায়ে রাজপথে নামছেন। এই সময়টা কাজে লাগাতে পারলে হয়তো দাবি পূরণ সম্ভব তাই তারা রাজপথে নামছেন। তবে আন্দোলন করতে গিয়ে যাতে মানুষের জনদুর্ভোগ না হয় সেই দিকে সবার দৃষ্টি থাকা প্রয়োজন।
কালের আলো/এমএএএমকে