গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের মানবেতর জীবন

প্রকাশিতঃ 9:45 pm | February 01, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন ত্বরান্বিত করতে গুলিতে প্রাণ হারান বংশালের মো.সোহাগ। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন দিশেহারা তাঁর পরিবার। স্বামীর মৃত্যুর পর শিশুসন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে স্ত্রী রীমা আক্তারকে। শনিবার (০১ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আকুতি জানিয়ে রীমা বলছিলেন-‘আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমরা আর পারছি না।’ কেন সরকার তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না, কেন দাবি আদায়ে তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে একই রকম অভিযোগ করে বক্তব্য রাখেন অন্তত ২০টি শহীদ পরিবারের সদস্য। সেখানে শহীদ কারও মা, কারও বাবা, কারও সন্তান, কারও ভাই, কারও স্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের একজন বীথি আক্তার। তাঁর স্বামী হাফিজুর রহমান ৫ আগস্ট আগারগাঁও এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ১৬ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। বীথি আক্তার সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘শহীদদের পরিবারের দাবি যদি মেনে না নেওয়া হয়, তবে আমাদেরও মেরে ফেলুন। আমাদের এখন বাঁচার কোনো দরকার নাই।’

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারগুলোর কোনো খোঁজ অন্তর্বর্তী সরকার নিচ্ছে না, এমন অভিযোগ এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবারগুলোর সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, অনেকের পরিবার মানবেতর জীবন পার করছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাঁদের পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এমনকি হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। শহীদদের এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দ্রুততম সময়ে এসব দাবি পূরণ না হলে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়া শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দাবি জানিয়ে বলেন, দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ পরিবারগুলোর সদস্যদের সঙ্গে সরকার বৈঠক না করলে রাজপথে অবস্থান ও অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে। ৪ ফেব্রুয়ারি এই ঘোষণা আসবে। সংবাদ সম্মেলনের শিরোনাম ছিল, ‘প্রতিটি হত্যার আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, শহীদ পরিবারের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন।’

নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরে বীথি আক্তার বলেন, ‘আমার বাচ্চা তো আমাকেই বলে, মা আমি ভাত খাব। মা আমাকে এটা দাও। বাড়িওয়ালা তো আমাদের বলে না এক মাসের ভাড়া দিয়ো না। সরকার যদি আমাদের দাবি না মেনে নেয়, তবে সকল শহীদ পরিবারকেই একেবারে শহীদ করে দিক। আমাদের মেরে ফেলা হোক, আমার বাচ্চাদেরও..তাহলে আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব। কেউ তাদের কাছে দাবি জানাইতে পারবে না। রাস্তায় এসে বসে থাকবে না।’

পরে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে বীথি আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী হাফিজুর রহমান পেশায় একজন গাড়িচালক ছিলেন। তাঁদের দুই মেয়ের মধ্যে একজনের বয়স ৮ বছর, অন্যজনের ৩ বছর। বড় মেয়ে আগে একটি স্কুলে পড়ত। তবে স্বামী মারা যাওয়ার পর আর্থিক সংকটে পড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছেন। এখন তাঁর পরিবারকে দেখার কেউ নেই।

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত ইমাম হাসানের (তাইম) ভাই রবিউল আউয়াল। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভাই হত্যার বিচার চেয়ে ছয় মাস ধরে তিনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরছেন। কিন্তু আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে না। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের ছয় মাস পরও শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

গত ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় নিহত সাজ্জাদ হোসেনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা শাহীনা বেগম। তিনি বলেন, তাঁর ছেলেকে কুকুর-বিড়ালের মতো হত্যা করার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ কোনো আসামিকে ধরা হচ্ছে না। তাঁর প্রশ্ন, আসামিই যদি ধরা না হয়, তাহলে হত্যার বিচার হবে কীভাবে?

শহীদ পরিবারগুলো নানা বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে নিহত শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের নানা সাইদুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘এই সরকার তো আমাদের সরকার। অথচ আমাদের সরকার আমাদের কোনো খোঁজ নিচ্ছে না।’ সাইদুর রহমান বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের পরিবারগুলোর খোঁজ নেওয়া। অথচ এখন আমাদেরই রাস্তায় নেমে দাবি জানাতে হচ্ছে। শহীদদের রক্তের ওপর এই সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত শহীদদের পরিবারগুলোর ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেওয়া।’

সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে পটুয়াখালী থেকে আসেন যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসানের বাবা মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, কী ছিল মেহেদীর অপরাধ? জনগণের কাছে সঠিক সংবাদ পৌঁছে দেওয়া কি অপরাধ? এটা কোনো সাংবাদিকের অপরাধ হতে পারে না। ফ্যাসিস্ট সরকার সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কারণে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাঁর ছেলে হত্যার বিচার এবং পরিবারের পুনর্বাসনে তাঁদের অনেক আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু কোনো আশ্বাস আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।

কালের আলো/এমএএএমকে