ট্রাম্পের শুল্কনীতির অস্থিরতায় বিশ্ব অর্থনীতির ঝুঁকি বাড়ছে
প্রকাশিতঃ 5:07 pm | February 04, 2025
আন্তর্জাতিক ডেস্ক, কালের আলো:
উত্তর আমেরিকাকে বাণিজ্যযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাসের শুরুতে কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেও পরে তা এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন তিনি। আলোচনার সুযোগ দিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেখানে অভিবাসন নীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য ইস্যুর মতো বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে ট্রাম্পের এই আচরণ আবারও তার অপ্রত্যাশিত ও অস্থির নীতি গ্রহণের প্রবণতাকে সামনে এনেছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে।
শেয়ারবাজারে প্রভাব
ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছিলেন, ‘এটি আমেরিকার স্বর্ণযুগ হবে! এর জন্য যে মূল্য দিতে হয়, তা দিতে হবে।’ সত্যি সত্যিই ৩ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের শুল্কনীতির কিছুটা মূল্য চুকায় বিশ্ব। এদিন বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ধস নামে, তেলের দাম বেড়ে যায় এবং ডলারের বিপরীতে বেশিরভাগ মুদ্রার দরপতন হয়। কিন্তু পরে যখন ট্রাম্প মেক্সিকো ও কানাডার ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন, তখন বাজার ফের স্থিতিশীল হয়ে যায়।
এই ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অনিশ্চয়তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, ট্রাম্প শেয়ারবাজারের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারেন এবং তা বিবেচনায় রেখেই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে ভবিষ্যতে এমন পদক্ষেপ আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কানাডা-মেক্সিকোর প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্প তার ঘোষণায় দাবি করেছেন, মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি বন্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাত পুনরুজ্জীবিত হবে। তবে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউডিয়া শেইনবাউম এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আপাতত আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
মেক্সিকো এরই মধ্যে সীমান্তে ১০ হাজার সেনা মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যারা ফেন্টানাইল পাচার রোধে কাজ করবে। অন্যদিকে, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে মাদক চোরাচালান ঠেকানোর ঘোষণা দিয়েছে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নতুন কিছু নয়, এগুলো আগে থেকেই চালু ছিল।
শিল্পখাতে প্রভাব
ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। বিশেষ করে, গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে। কানাডা ও মেক্সিকোতে উৎপাদিত বিভিন্ন যন্ত্রাংশ একাধিকবার সীমান্ত পার হয়ে চূড়ান্তভাবে একত্রিত হয়। ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে উৎপাদন ব্যয় এতটাই বেড়ে যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বৃহৎ গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান—স্টেলান্টিস, জেনারেল মোটরস ও ফোর্ড—লাভজনক থাকতে পারবে না বলে জানিয়েছে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান বার্কলেস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটলে ছোট কোম্পানিগুলো টিকে থাকতে পারবে না এবং অনেক উৎপাদন ইউনিট বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি, কিছু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সতর্কবার্তা
ট্রাম্পের এ ধরনের নীতির ফলে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগামীতে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়বে। একদিকে তারা কানাডা ও মেক্সিকোতে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও বড় ধরনের প্রকল্প চালু করার আগে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা ঠিক থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীনের ওপর শুল্ক আরোপের কারণে ২০১৮ সালে দেশটির বিনিয়োগ কমপক্ষে ১ শতাংশ কমে যায়। এবার ট্রাম্পের পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত এবং এতে আরও বেশি দেশ ও শিল্পখাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প তার শুল্কনীতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তার এই নীতি বাস্তবায়িত হলে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগ কমে যাবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কালের আলো/এএএন/কেএ