চলন্ত অবস্থায় বিকল হচ্ছে ট্রেনের ইঞ্জিন

প্রকাশিতঃ 6:28 pm | February 04, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

জামালপুর-চট্টগ্রাম রুটে নিয়মিত চলাচল করে আন্তঃনগর বিজয় এক্সপ্রেস। ২০২৪ সালের ২৪ মে জামালপুর থেকে চট্টগ্রাম যেতে ট্রেনটিতে চারটি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল। জামালপুর থেকে ট্রেনটিকে টেনে আনছিল রেলওয়ের ২৯১৯ নম্বর ইঞ্জিন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর স্টেশন এলাকার কাছে এসে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যায়। পরে ময়মনসিংহ থেকে ২৬১৪ নম্বর ইঞ্জিন এনে রওনা করে ট্রেনটি। ওই ইঞ্জিন বিজয় এক্সপ্রেসকে নিয়ে ভৈরব সেতুতে উঠতে না পারায় আখাউড়া থেকে ২৯২৩ নম্বর ইঞ্জিন এনে ট্রেনটিকে টেনে নেওয়া হয়। কিন্তু এই ইঞ্জিনও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বারৈয়ারঢালা এলাকায় গিয়ে বিকল হয়। পরে চট্টগ্রাম থেকে ২৯৩৭ নম্বর ইঞ্জিন এনে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেওয়া হয় ট্রেনটিকে।

শুধু এই ঘটনাটিই নয়, গত বছরের ডিসেম্বরে রেলের পূর্বাঞ্চলে (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ) ৩১টি যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়। একই মাসে পূর্বাঞ্চলে মালবাহী আরও সাতটি ট্রেন বিকল হয়। অন্যদিকে ডিসেম্বরে পশ্চিমাঞ্চলে (রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগ) ১১টি যাত্রীবাহী ও দুটি মালবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়। সব মিলিয়ে ওই মাসে ৪২টি যাত্রীবাহী ও ৯টি মালবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন চলাচলের পথে বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। এর আগে ২০২৩ সালে ২৭৩ বার চলন্ত অবস্থায় ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে সংখ্যাটি ছিল ২০৩ বার। চলন্ত অবস্থায় বিকলের এই ঘটনায় পুরোনো ইঞ্জিনগুলোর বেশিরভাগই সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকেই দায়ী করা হচ্ছে। ইঞ্জিন সংকট মোকাবিলায় রেলের কোন প্রস্তুতি না থাকায় এমনটি হচ্ছে। ফলে চলন্ত অবস্থায় ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় কমছে চলাচলকারী ট্রেনের সংখ্যা।

জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে রেলের উন্নয়নে এক লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়। নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণেই খরচ করা হয় বেশি। কিন্তু তার সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়নি। ফলে রেলপথ বাড়লেও চলাচলকারী ট্রেনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১২ সালের দিকে তিন শতাধিক যাত্রীবাহী ট্রেন চলত। বর্তমানে চলছে ২২৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন। বন্ধ আছে ৯৩টি। অবশ্য কাগজে-কলমে ট্রেনের সংখ্যা দেখানো হয় ৩২১। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু আন্তনগর ট্রেন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে লোকাল, কমিউটার ও মেইল ট্রেন। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন ১২টি ট্রেন চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা থেকে গাজীপুর পথে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেন বেশি। তা না হলে বন্ধ ট্রেনের সংখ্যা আরও বেশি দাঁড়াত।

একই সূত্র বলছে, বর্তমানে রেলের বহরে মোট ইঞ্জিন রয়েছে ২৯৭টি। এর মধ্যে মিটারগেজ ইঞ্জিন ১৬৭টি ও ব্রডগেজ ইঞ্জিন ১৩০টি। রেলট্র্যাকে যুক্ত হওয়ার পর একটি ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল রয়েছে রেলওয়েতে এমন ইঞ্জিনের সংখ্যা ১৪৭টি। বাকি ১৫০টি ইঞ্জিনের মধ্যে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী রয়েছে ৫০টি ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী রয়েছে ১৬টি। অবশিষ্ট ৮৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বর্তমান রেলওয়ের বহরে থাকা ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ৫১ শতাংশের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ৭০টি নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়। আর ৩০টি পুরোনো ইঞ্জিন অনুদান হিসেবে দিয়েছে ভারত। বর্তমানে ইঞ্জিন কেনার নতুন কোনো প্রকল্প নেই। ফলে শিগগিরই সংকট কাটবে না বলে মনে করছেন রেলের কর্মকর্তারা। ফলে নতুন ট্রেন চালু করা সম্ভব হবে না। এখন নতুন কোনো পথে ট্রেন চালু করতে হলে অন্য কোনো পথে বন্ধ করে সেখান থেকে ইঞ্জিন নিয়ে আসতে হবে।

সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময় রেলে নতুন ইঞ্জিন বিকলের ঘটনাও ঘটছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২০২১ সালে ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকায় ৩০টি নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়। একেকটি ইঞ্জিনের দাম পড়েছে ৩৮ কোটি টাকা। নতুন এসব ইঞ্জিনের অন্তত চারটি বিকল হয়ে কারখানায় পড়ে আছে। নতুন ইঞ্জিনে সাধারণত বড় ধরনের মেরামতের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কোরিয়া থেকে আনা ইঞ্জিনের বড় মেরামত দরকার হচ্ছে। যেমন রেলওয়ের ৩০১০ নম্বর ইঞ্জিনটি কোরিয়া থেকে আনা। গত নভেম্বরে এই ইঞ্জিনও ভারী মেরামতের জন্য ঢাকায় লোকোমোটিভ কারখানায় নেওয়া হয়। এখনো মেরামতকাজ চলছে। ২০১৮ সালের ১৭ মে এসব ইঞ্জিন কিনতে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রথম ধাপে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আসে ১০টি ইঞ্জিন। পরে আরেকটি প্রকল্পে ৮৪১ কোটি টাকায় আরও ২০টি ইঞ্জিন কেনা হয়। যদিও চুক্তি অনুযায়ী, তিন হাজার হর্স পাওয়ারের (ক্ষমতা) ইঞ্জিনের বদলে দেওয়া হয়েছে দুই হাজার হর্স পাওয়ারের। আবার, চুক্তি মোতাবেক ইঞ্জিন না আসায় সেগুলো প্রায় ছয় মাস ফেলে রাখা হয়। একাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। তারপরও ইঞ্জিন গ্রহণ করা হয়।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘ব্রডগেজ ইঞ্জিনে তেমন কোনো সমস্যা নেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছি মিটারগেজ ইঞ্জিন নিয়ে। মিটারগেজ ইঞ্জিনের স্বল্পতা রয়েছে। এখন যত ইঞ্জিন আছে, তার বেশিরভাগই পুরাতন। মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর ফেইল করার সংখ্যা এখন বেশি। নতুন ৩০০০ সিরিজ ইঞ্জিনেও কিছু সমস্যা আছে। মিটারগেজ ইঞ্জিন যেগুলো আছে, সেগুলো মেরামতের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ বছর ২৪টি মিটারগেজ ইঞ্জিন মেরামত করে লাইনে ফেরাব। প্রতি মাসে দুটি করে মিটারগেজ ইঞ্জিন লাইনে ফেরানোর টার্গেট রয়েছে।’

কালের আলো/আরআই/এমকে