স্থানীয় সরকার নির্বাচন জুনেই সম্ভব : সংস্কার কমিশন
প্রকাশিতঃ 11:24 am | February 23, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একসঙ্গে করার প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া আগামী জুনের মধ্যে দেশের সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব বলে জানিয়েছে তারা। গতকাল শনিবার কমিশনের প্রকাশিত প্রাথমিক রিপোর্টে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।
সুপারিশে বলা হয়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে কার্যত কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নেই।
এই মুহূর্তে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব। আগামী জুনের মধ্যে সব সমতল ও পাহাড়ের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।
সুপারিশে আরো বলা হয়, বর্তমানে নতুন একটি স্বচ্ছ ক্যানভাসে নতুন ছবি আঁকা সম্ভব। নতুবা নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আইনি জটিলতার উদ্ভব হতে পারে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সংসদীয় পদ্ধতি চালু করার আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে জনপরিসরে থাকলেও কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি।
এখন সে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আগামী মার্চ-এপ্রিলের (২০২৫) মধ্যে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুটি একীভূত এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। গত ১৮ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনসহ আরো পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে এই সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে কাজ করেছেন সাতজন সদস্য।
একই সঙ্গে ভোট, আইন একীভূত করার সুপারিশ
সংস্কারের সুপারিশে বলা হয়, একই তফসিলে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন অংশগ্রহণ করবে। প্রতিজন ভোটার নিজ নিজ ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটির ওয়ার্ডের জন্য একটি ব্যালট পেপার, উপজেলার জন্য একটি এবং জেলার জন্য একটি ব্যালট পেপার পাবেন। তিনটি ব্যালটে তিনটি বা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) একাধিক ভোট দিয়ে তাঁদের ভোট শেষ করবেন।
সুপারিশে বলা হয়, ১৯৭২ সালের পর পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য পারস্পরিক সম্পর্কবিহীন যে পাঁচটি পৃথক আইন ও অসংখ্য বিধিমালা বিভিন্ন সময় জারি করা হয়েছে, সে সব আইন ও বিধিসমূহ বাতিল করে সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দুটি একীভূত ও একক স্থানীয় সরকার আইন ও প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করে সব পরিষদের মধ্যে আন্ত প্রতিষ্ঠান সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ রকম দুটি আইন করা হলে ওই আইন বলে পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো হবে একই ধাঁচের সংসদীয় পদ্ধতির। তখন নির্বাচনব্যবস্থাটিও হবে সহজ, ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী।
থাকবে স্থানীয় সরকার সার্ভিস
গ্রাম ও নগরের সর্বত্র সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো হবে সমরূপ। স্থানীয় সরকারের ‘স্থানীয় সরকার সার্ভিস’ নামে একটি নিজস্ব সার্ভিস কাঠামো থাকবে। সেই সার্ভিসের অধীন জনবলের ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী পদায়নের সুযোগ থাকবে। কর্মচারীদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত অভিগম্যতা থাকলে পদোন্নতি ও পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। মন্ত্রণালয়ের নামও পরিবর্তন ‘স্থানীয় সরকার, জনসংগঠন ও জনপ্রকৌশল সেবা’ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পৃথক অধিদপ্তর গঠনের সুপারিশ
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পৃথক অধিদপ্তর গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন৷ স্থানীয় সরকার বিভাগে বর্তমানে কার্যরত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অধিদপ্তরকে অধিকতর শক্তিশালী করে একটি পুনর্গঠিত নতুন অধিদপ্তর গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে৷ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত সব প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম এই অধিদপ্তরের আওতাধীন হবে।
বিভাগীয় কমিশনার অফিসের পরিচালক স্থানীয় সরকার এবং ডেপুটি কমিশনার অফিসের সঙ্গে সংযুক্ত উপপরিচালক স্থানীয় সরকারের পদসমূহ বিলুপ্ত হবে। একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার অধীনে অন্যূন ১০ জনের একটি সংগঠন ওপরে বিবৃত অধিদপ্তরের অধীনে প্রতিটি জেলায় কাজ করবে।
স্থানীয় সরকারের স্তর কমানোর সুপারিশ
আগামী ১০ বছরের মধ্যে স্থানীয় সরকারের স্তরসংখ্যা হ্রাস করে গ্রাম-শহরের পার্থক্য কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নতুন পদ্ধতির অধীনে নিম্নলিখিত তিনটি নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয় সুপারিশে। বর্তমানে ১৯৬০-এর দশকের (পাকিস্তান আমলের) জেনারেল আইয়ুব খান প্রবর্তিত রাষ্ট্রপতিব্যবস্থার আদলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংসদীয় পদ্ধতির আদলে পুনর্বিন্যস্ত করা হবে।
তিনটি পৃথক আইনের বদলে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদকে একটি একক আইনের অধীনে আনা হবে। একইভাবে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকে ভিন্ন একটি একক আইনের অধীনে আনা হবে। বর্তমানে বিরাজিত পাঁচটি পৃথক আইনের স্থলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুটি মৌলিক আইনের অধীনে আনা যেতে পারে। নতুন আইনের অধীনে একই তফসিলে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির অধীনে আনয়নের সুপারিশ করা হয়।
স্থানীয় সরকারকে সংসদীয় আদলে পরিচালনার সুপারিশ
জাতীয় সংসদে যেমন নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা থাকেন সব সংসদীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু, গ্রাম ও নগর নির্বিশেষে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য বা কাউন্সিলররা হবেন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান নিয়ামক। সুপারিশে বলা হয়েছে, গ্রাম-নগর নির্বিশেষে প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামো দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত থাকবে, (১) বিধানিক অংশ এবং (২) নির্বাহী অংশ।
বিধানিক অংশের প্রধান হবেন ‘সভাধ্যক্ষ’ (জাতীয় সংসদের স্পিকারের অনুরূপ) এবং নির্বাহী অংশের প্রধান হবেন ‘চেয়ারম্যান’ বা ‘মেয়র’। তিনি পরিষদ বা কাউন্সিল নেতা হিসেবেও থাকবেন। সভাধ্যক্ষ জাতীয় সংসদের স্পিকারের অনুরূপ দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে পরিষদের সভা-অধিবেশন আহবান করবেন। সব সদস্য-সদস্যা যাতে তাঁদের মতামত দিতে পারেন, কোনো বিশেষ বিষয়ে বিতর্কে অংশ নিতে পারেন, সেসব বিষয় তিনি নিশ্চিত করবেন।
তেমনিভাবে সব স্থায়ী কমিটি গঠন ও সভা নিয়মিত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সভাধ্যক্ষকে সহায়তা করবেন একজন পূর্ণকালীন ‘সচিব’ এবং পাঁচ সদস্যের একটি সচিবালয়। সাধারণ নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গেজেট প্রকাশের পর সদস্যরা আইনে নির্ধারিত একটি শপথনামা উপস্থিত একটি ভোটার সমাবেশে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থে হাত রেখে একে একে উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করে সেটিতে স্বাক্ষর করবেন এবং সদস্যদের জন্য রক্ষিত আসনে আসন গ্রহণ করবেন।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সাংবিধানিক মর্যাদাসম্পন্ন একটি স্থায়ী ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করার সুপারিশ করা হয়।
সব উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপনের সুপারিশ
সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের পাশাপাশি একই পদমর্যাদায় প্রতিটি উপজেলায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন সিনিয়র সহকারী জজ এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় স্থাপন করা।
ইউনিয়ন পরিষদের অধীন গ্রাম আদালত বিলুপ্ত করে ওয়ার্ড পর্যায়ে সালিসি ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দান এবং সালিসসমূহের তত্ত্বাবধান, সালিসকারদের প্রশিক্ষণ ও সালিসের আপিল শুনানির জন্য এডিআর আদালতের বিচারকের এখতিয়ার ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে।
কালের আলের/এসএকে