বাংলা একাডেমির অপ্রচলিত প্রমিত বানান : বিদ্যমান বাস্তবতা ও করণীয়
প্রকাশিতঃ 6:31 pm | February 26, 2025

মো. মামুন অর রশিদ:
বাংলা একাডেমির অভিধানে এমন কিছু অপ্রচলিত প্রমিত বানান রয়েছে, যেগুলো বাংলা একাডেমি নিজেই ব্যবহার করে না। গত ১লা ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এর ‘উদ্বোধন’ অনুষ্ঠানের ব্যানারে ‘উদ্বোধন’ বানানটি লেখা হয়েছে এভাবে ‘উদ্বোধন’। গত বেশ কয়েকটি বইমেলায় বাংলা একাডেমি ‘উদ্বোধন’ বানানটি ব্যবহার করেছে। গণমাধ্যমসহ প্রায় সর্বত্র ‘উদ্বোধন’ বানানটি বহুলপ্রচলিত। কিন্তু বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘উদ্বোধন’ বানানটি প্রমিত হিসাবে স্থান পেয়েছে। উচ্চারণ জটিলতা এড়ানোর জন্য ‘উদ্’ উপসর্গটি পৃথক রাখা হয়েছে। আমরা জানি, বাংলা উচ্চারণরীতি-অনুযায়ী পদের মধ্যে কিংবা শেষে ‘ব’ ফলা থাকলে সংযুক্ত বর্ণের উচ্চারণ-দ্বিত্ব হয়। যেমন : বিদ্বান (উচ্চারণ : বিদ্দান্)। উচ্চারণরীতি-অনুযায়ী ‘উদ্বোধন’-এর উচ্চারণ হওয়া উচিত ‘উদ্দোধন্’। তাই, ‘উদ্বোধন’ বানানে ‘উদ্’ উপসর্গটি পৃথক রাখাই যুক্তিযুক্ত। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান-অনুযায়ী ‘উদ্বুদ্ধ’, ‘উদ্বেগ’, ‘উদ্বেল’, ‘উদ্বিগ্ন’ শব্দের প্রমিত রূপ হচ্ছে— ‘উদ্বুদ্ধ’, ‘উদ্বেগ’, ‘উদ্বেল’, ‘উদ্বিগ্ন’।
‘প্রমিতকরণ’, ‘পবিত্রকরণ’, ‘নির্মূলকরণ’, ‘লঘুকরণ’, ‘দৃঢ়করণ’, ‘প্রমাণকৃত’, ‘উৎসর্গকৃত’, ‘পূরণকৃত’, ‘পুঞ্জিভূত’ প্রভৃতি বানান বহুলপ্রচলিত। এসব বানান বহুলব্যবহৃত হলেও অশুদ্ধ। তৎসম শব্দের শেষে ‘চ্বি-প্রত্যয়’-সহ ‘করণ’, ‘কৃত’, ‘ভবন’, ‘ভূত’ প্রত্যয় যুক্ত হলে ঈ-কার/ঊ-কার ব্যবহৃত হয়। উল্লিখিত বানানসমূহের শুদ্ধ রূপ হলো : ‘প্রমিতীকরণ’, ‘পবিত্রীকরণ’ ‘নির্মূলীকরণ’, ‘লঘূকরণ’, ‘দৃঢ়ীকরণ’, ‘প্রমাণীকৃত’, ‘উৎসর্গীকৃত’, ‘পূরণীকৃত’, ‘পুঞ্জীভূত’।
শব্দের শুরুতে ‘বিপদ’ যুক্ত হয়ে যেসব শব্দ গঠিত হয়, সেসব শব্দ লিখতেও অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। ‘বিপদকাল’, ‘বিপদকালীন’, ‘বিপদচিহ্ন’, ‘বিপদপাত’, ‘বিপদসংকুল’, ‘বিপদসংকেত’ ও ‘বিপদসীমা’ বানান বহুলপ্রচলিত হলেও অশুদ্ধ। উল্লিখিত বানানের শুদ্ধ রূপ হলো : ‘বিপৎকাল’, ‘বিপৎকালীন’, ‘বিপৎচিহ্ন’, ‘বিপৎপাত’, ‘বিপৎসংকুল’, ‘বিপৎসংকেত’ ও ‘বিপৎসীমা’। তাই শব্দের শুরুতে ‘বিপদ’ লেখার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
‘ব্যবহারিক’ নাকি ‘ব্যাবহারিক’— কোনটি শুদ্ধ? কয়েক বছর আগেও ‘ব্যবহারিক’ বানান বাংলা একাডেমির অভিধানভুক্ত ছিল। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি-প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ’ গ্রন্থের নামকরণেও ‘ব্যবহারিক’ বানান ব্যবহৃত হয়েছে। ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’-এর সর্বশেষ সংস্করণে ‘ব্যাবহারিক’ বানানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু ‘ব্যবহারিক’ বানানকে স্থান দেওয়া হয়নি। ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এ ‘ব্যবহারিক’ ও ‘ব্যাবহারিক’— দুটি বানানই রাখা হয়েছে। ‘ব্যবহার’-এর সঙ্গে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘ব্যাবহারিক’ হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘সমাজ’ থেকে ‘সামাজিক’, ‘চরিত্র’ থেকে ‘চারিত্রিক’, ‘ধর্ম’ থেকে ‘ধার্মিক’, ‘বর্ষ’ থেকে ‘বার্ষিক’ প্রভৃতি।
‘ইশতেহার’ বহুলব্যবহৃত একটি শব্দ। নির্বাচন এলে শব্দটির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ‘ইশতেহার’ বানান বহুলপ্রচলিত হলেও বাংলা একাডেমির অভিধানভুক্ত নয়। ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ‘ইশতাহার’ শব্দকে স্থান দেওয়া হয়েছে। ‘ইশতাহার’ আরবি উৎসের শব্দ। ইশতাহার অর্থ প্রচারপত্র, বিজ্ঞাপন, নোটিশ প্রভৃতি। ‘সংযোগ’ বা ‘যোগাযোগ’ বুঝাতে অনেকে ‘সেতুবন্ধন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘সেতুবন্ধন’ বানানটি বহুলব্যবহৃত হলেও অশুদ্ধ। শুদ্ধ হলো ‘সেতুবন্ধ’। ‘সেতুবন্ধন’ বানান অশুদ্ধ হলেও ‘মেলবন্ধন’ বানানটি কিন্তু শুদ্ধ। তাই ‘সেতুবন্ধ’ ও ‘মেলবন্ধন’ বানানে ‘ন’ ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত।
অনেকের লেখায় ‘সমৃদ্ধশালী’ শব্দটি প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। ‘সমৃদ্ধশালী’ বানানটি অশুদ্ধ। ‘সমৃদ্ধ’ বিশেষণ পদ। ‘সমৃদ্ধ’ অর্থ ঐশ্বর্যশালী, সম্পৎশালী, উন্নত প্রভৃতি। ‘সমৃদ্ধ’-এর পর ‘শালী’ যুক্ত করার প্রয়োজন নেই। অপরদিকে ‘সমৃদ্ধি’ অর্থ সম্পদ, প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য প্রভৃতি। ‘সমৃদ্ধিশালী’ অর্থ সম্পৎশালী বা ঐশ্বর্যশালী। তাই ‘সমৃদ্ধশালী’-র পরিবর্তে ‘সমৃদ্ধ’ বা ‘সমৃদ্ধিশালী’ ব্যবহার করতে হবে।
অনেকেই নিজেকে ‘রুচিবান’ বা ‘সংস্কৃতিবান’ ভাবেন। ‘রুচিবান’ বা ‘সংস্কৃতিবান’ বানান ঠিক কি না— এটি নিয়ে খুব কম মানুষেই ভাবেন। বাস্তবতা হলো— ‘রুচিবান’ ও ‘সংস্কৃতিবান’ বানান দুটি অশুদ্ধ। ‘বান’ প্রত্যয় অ-কারান্ত ও আ-কারান্ত শব্দের শেষে যুক্ত হয়। যেমন : গুণবান, জ্ঞানবান, ধনবান, প্রজ্ঞাবান, ভাগ্যবান প্রভৃতি। ‘মান’ প্রত্যয় ই/ঈ-কারান্ত ও উ/ঊ-কারান্ত শব্দের শেষে যুক্ত হয়। যেমন : রুচিমান, সংস্কৃতিমান প্রভৃতি। তাই ‘রুচিবান’ ও ‘সংস্কৃতিবান’-এর পরিবর্তে ‘রুচিমান’ ও ‘সংস্কৃতিমান’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করতে হবে।
অকারণে শব্দের শেষে ঈ-প্রত্যয় যোগ করা একটি অপপ্রয়োগ। অনেকে শব্দের শেষে ঈ-প্রত্যয় যোগ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ‘নির্দোষী’, ‘নিরহংকারী’, ‘নিরভিমানী’, ‘বিদেহী’, ‘প্রকাশনী’, ‘সংশোধনী’, ‘ভয়ংকরী’, ‘অতলস্পর্শী’ প্রভৃতি শব্দের শেষে ঈ-প্রত্যয় যুক্ত হবে না। শুদ্ধ রূপ হলো— ‘নির্দোষ’, ‘নিরহংকার’, ‘নিরভিমান’, ‘বিদেহ’, ‘প্রকাশন’, ‘সংশোধন’, ‘ভয়ংকর’ ও ‘অতলস্পর্শ’।
‘চক্ষু’ বানান নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ‘চক্ষু’-র সঙ্গে ‘রোগ’ বা ‘রাগ’ যুক্ত হলে যত বিপত্তি। ‘চক্ষুরোগ’ ও ‘চক্ষুরাগ’ বানান দুটি বহুলপ্রচলিত হলেও অশুদ্ধ। শব্দ দুটির শুদ্ধ রূপ হলো— ‘চক্ষূরোগ’ ও ‘চক্ষূরাগ’। তবে, ‘লোকচক্ষু’ বানানে কোনো সমস্যা নেই।
যা চাওয়া হয়েছে— তা বুঝানোর জন্য অনেকে ‘চাহিত’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘চাহিত’ শব্দটি অভিধানভুক্ত নয়। যা চাওয়া হয়েছে— তা বুঝানোর জন্য ‘যাচিত’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘যাচিত’ অর্থ চাওয়া হয়েছে এমন বা প্রার্থিত। যেমন : ‘যাচিত তথ্য প্রেরণ করা হলো’।
ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া সকলেই ‘সংজ্ঞার্থ’ অর্থে ‘সংজ্ঞা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। ‘সংজ্ঞা’ অর্থ চেতনা, অনুভূতি, জ্ঞান, বুদ্ধি প্রভৃতি। ‘সংজ্ঞার্থ’ অর্থ কোনো শব্দের যথাযথ অর্থ প্রকাশকারী ব্যাখ্যা। শব্দের যথাযথ অর্থ প্রকাশ করতে কিংবা ‘কী’ বা ‘কাকে বলে’ বুঝাতে ‘সংজ্ঞার্থ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে। যেমন : সে পরীক্ষায় সন্ধির সংজ্ঞার্থ লিখতে ভুলে গিয়েছে।
‘হিস্যা’ ও ‘মফস্বল’ বানান দুটি বহুলপ্রচলিত। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান-অনুযায়ী বানান দুটির প্রমিত রূপ হলো— ‘হিস্সা’ ও ‘মফস্সল’। ‘স্টুডিও, ‘রেডিও’ ও ‘ভিডিও’ বানান তিনটিও বহুলব্যবহৃত ও প্রতিষ্ঠিত। বানান তিনটির প্রমিত রূপ হলো— ‘স্টুডিয়ো, ‘রেডিয়ো’ ও ‘ভিডিয়ো’। ‘মাগরিব’ শব্দটিও বহুলব্যবহৃত, কিন্তু অভিধানভুক্ত নয়। ‘মগরেব’ ও ‘মগরিব’ শব্দ দুটি বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে স্থান পেয়েছে।
গণমাধ্যম, সরকারি দপ্তর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র বহুলপ্রচলিত আরও কিছু শব্দ হলো— ‘অনুষ্ঠিতব্য’, ‘হীনমন্যতা’, ‘এখতিয়ার’, ‘অস্ত্রপাচার’, ‘মেডিকেল’, ‘ঠেলাগাড়ি’, ‘ডায়েরি’, ‘টমেটো’, ‘ক্যান্সার’, ‘ভর্তুকি’। বহুলপ্রচলিত হলেও শব্দগুলো প্রমিত নয়। উল্লিখিত শব্দসমূহের প্রমিত রূপ হলো— ‘অনুষ্ঠেয়’, ‘হীনম্মন্যতা’, ‘এক্তিয়ার’, ‘অস্ত্রোপচার’, ‘মেডিক্যাল’, ‘ঠ্যালাগাড়ি’, ‘ডায়ারি’, ‘টম্যাটো’, ‘ক্যানসার’, ‘ভরতুকি’।
বাংলা একাডেমির অভিধানভুক্ত বানান অপ্রচলিত হলেও তা শুদ্ধ ও প্রমিত। অপ্রচলিত প্রমিত বানান অভিধানে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে অনেকের কাছে তা অশুদ্ধ মনে হতে পারে। অভিধানে সীমাবদ্ধ এসব বানান বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমিকে প্রচারের দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক, সরকারি দপ্তর ও গণমাধ্যমে এসব বানান ব্যবহার করতে হবে। এটি করা সম্ভব না হলে বহুলপ্রচলিত কিন্তু অভিধানভুক্ত নয়, এমন শব্দসমূহকে বাংলা একাডেমির অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে বহুলপ্রচলিত কয়েকটি পত্রিকার নিজস্ব বানানরীতি রয়েছে। এ ধরনের বানানরীতি বাংলা বানানে জটিলতা সৃষ্টি করছে। এই জটিলতা নিরসনে গণমাধ্যমের সঙ্গে বাংলা একাডেমির একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। সরকারি দপ্তর-সংস্থা ও পাঠ্যপুস্তকে শুদ্ধভাবে বাংলা লেখা হচ্ছে কিনা— সেটিও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
পত্রিকা, টেলিভিশনের স্ক্রল, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, দাপ্তরিক পত্র, ব্যক্তিগত পত্র, ব্যানার, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, নামফলক, দেওয়াল লিখন, পোস্টার, লিফলেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম— সর্বত্র বাংলা ভুল বানানের ছড়াছড়ি। মনে হচ্ছে শুদ্ধভাবে বাংলা লেখার আগ্রহী লোকের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এই প্রবণতা বাংলা ভাষার জন্য অমর্যাদাকর।
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা হলো মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। মাতৃভাষার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের অংশ হিসাবে সবাইকে শুদ্ধভাবে বাংলা লেখায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশের সর্বত্র শুদ্ধভাবে বাংলা লেখার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বানানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। বাংলা একাডেমির সক্রিয় তত্ত্বাবধানে দেশের সর্বত্র বাংলা বানানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে— এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।