বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলীকে নিয়ে কূটকৌশলের নেপথ্য কারা?
প্রকাশিতঃ 10:02 pm | March 04, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প (থার্ড টার্মিনাল) কাজের পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) মো.মাকসুদুল আলম। এই প্রকল্পে মাত্র ১ মাস ৫ দিন খন্ডকালীন পিডি ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো.হাবিবুর রহমান। ওই সময় তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। একইভাবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিএনএস-এটিএম (কমিউনিকেশন, নেভিগেশন, সার্ভিল্যান্স ও এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) সিস্টেমসহ রাডার স্থাপন, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কোনটিতেই পিডি হিসেবে ছিলেন না হাবিবুর রহমান। কিন্তু এসব বিমানবন্দরে উন্নয়ন প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ যে ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে তাঁর মধ্যে রয়েছে হাবিবুর রহমানের নামও। অথচ এসব প্রকল্পের সঙ্গে তাঁর ন্যূনতম কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। হয়রানির উদ্দেশ্যেই এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে বেবিচক’র ভেতরে-বাইরে গুঞ্জন-গুঞ্জরণ রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতনের পর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তাঁর নিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে শুরু থেকেই নানা ফন্দিফিকির আঁটতে থাকে বেবিচকে ঘাপটি মেরে থাকা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেমে থাকেনি অপতৎপরতা। তাকে ফাঁসাতে কল্পিত সব দুর্নীতির অভিযোগের মাধ্যমে ঘায়েল করার সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পুনরায় তাঁর এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ঠেকাতে এখন চলছে নানামুখী অপপ্রচার। সোমবার (৩ মার্চ) বেবিচকের বোর্ড সভায় তার নিয়োগের বিষয়ে সর্বসম্মতি প্রদান করা হয়। এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবনায় স্বাক্ষর করেছেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া। মূলত বেবিচকের গুরুত্বপূর্ণ চলমান সব প্রকল্প দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে তাঁর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চান বেবিচক চেয়ারম্যান। আর এ কারণেই হাবিবুর রহমানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়ার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কূটকৌশল থিওরিতে তাকে জেরবার করার সব অপপ্রয়াস দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। বেবিচক’র একজন চাকরিচ্যুত কর্মচারী চিহ্নিত একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এসব অপপ্রচারের রসদ জোগাচ্ছেন। ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিং ও চাঁদাবাজির অভিযোগে বিমানবন্দর থানায় দু’টি সাধারণ ডায়েরি করেছেন বেবিচক’র দু’জন প্রকৌশলী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া কালের আলোকে বলেন, ‘বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। আমরা বোর্ড সভায় তাকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা এই সংক্রান্ত প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট হওয়ার পর তিনি স্থলাভিষিক্ত হবেন।’ তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের চারটি মামলার বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। এখনও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। যতক্ষণ না তিনি দোষী প্রমাণিত হচ্ছেন, ততক্ষণ আমরা তাকে দোষী বলতে পারবো না। তিনি পরিস্থিতির শিকারও হতে পারেন। সব বিষয়গুলো আমলে নিয়েই আমরা তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। আমরা আমাদের চলমান প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছি।’
জানা যায়, ছাত্রজীবনে খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বেবিচকের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো.হাবিবুর রহমান। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এ কারণে বিভিন্নভাবে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে ২০২২ সালে তাঁর প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার কথা থাকলেও ওই সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে এই বিষয়ে আপত্তির কারণে তিনি এই পদে অভিষিক্ত হতে পারেননি। উল্টো এই অভিযোগে তাকে বেবিচকের প্রকৌশলী বিভাগ থেকেই বের করে দেওয়া হয়। প্রকৌশল শাখার বাইরে ফ্লাইট সেফটিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে তাকে অন্যায়ভাবে পদায়ন করা হয়। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়টিতে তাঁর ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। আবার এখন তাকে আওয়ামী লীগ ‘ট্যাগ’ দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ৩শ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাতিলের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় জোরপূর্বক এসব প্রকল্প গ্রহণ করেছিল পতিত সরকার। পটপরিবর্তনের পর এসব প্রকল্পের ঠিকাদাররা পালিয়ে যান। বেবিচক’র চেয়ারম্যান পদে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব বিষয় তাঁর নজরে আসে। কাজগুলো নতুনভাবে সরকার নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তিনি। উন্নয়নমূলক এসব কাজের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাধ্যবাধকতা, ডিপিডি না মানা, ফিজিবিলিটি স্টাডি না হওয়া এবং বিমাসংক্রান্ত কাগজপত্র জমা না দেওয়ায় প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় এসব প্রকল্প বাতিলে বেবিচক চেয়ারম্যানকে প্রকৌশলগত বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। পাশাপাশি বেবিচক’র চেয়ারম্যানের নির্দেশে পুরো কাজ শেষ না করেই বিল উত্তোলনের চিরায়ত প্রথাও তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব কারণেই মহল বিশেষের চক্ষুশূল হয়েছেন হাবিবুর রহমান। বেবিচক’র এই হার্ডলাইনের ফলে ঘৃণ্য কায়দায় তাকে হেনস্থার অপকৌশল বাড়বাড়ন্ত হয়ে ওঠেছে।
বেবিচক সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে (থার্ড টার্মিনাল) ৫৫০টি ভেরিয়েশন রয়েছে। এই ভেরিয়েশনগুলো চূড়ান্ত করার জন্য দক্ষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নেই বেবিচকে। এটিকে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের মতো দক্ষ, যোগ্যতাসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ প্রধান প্রকৌশলী প্রয়োজন। তাকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবনার বিষয়েও এটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে বেবিচক।
সূত্র মতে, সাধারণত ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ারস (এফআইডিআইসি) এর অধীনেই আন্তর্জাতিক কাজগুলোর দরপত্র আহ্বান করা হয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কাজগুলো বাংলাদেশের পিপিআর অনুযায়ী হয় না। এফআইডিআইসি এর ওপর নির্ভর করেই এই কাজগুলো করতে হয়। এই নিয়মের ওপর ভিত্তি করেই ৫৫০টি ভেরিয়েশন সম্পন্ন করতে হবে। এই এফআইডিআইসি’র ওপর সিভিল এভিয়েশনের মাত্র দু’জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। হাবিবুর রহমান তাদের একজন। তিনিসহ অন্য আরেকজন ডেনমার্ক থেকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে এসেছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো.হাবিবুর রহমান কালের আলোকে বলেন, ‘আমি সব সময় সততা ও দক্ষতার সঙ্গে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। বিগত সরকারের সময়ে নানাভাবে আমি বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাবনার বিষয়টি আমি শুনেছি। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার কর্তৃপক্ষের।’
কালের আলো/আরআই/এমএসএকে