থামছে না গণপিটুনির ঘটনা
প্রকাশিতঃ 10:32 pm | March 05, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
সম্প্রতি দেশে গণপিটুনিতে মানুষকে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। ডাকাত, চোর, ছিনতাইকারী সন্দেহেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। দেশের মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এসবের বাইরে ধর্মীয় অবমাননা এবং ছেলেধরার অভিযোগেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের উদাহরণ খুব বেশি নেই। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা আইনের আওতায় না আসায় এ ধরনের ঘটনা থামছে না বলে মনে করছে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)।
বুধবার (৫ মার্চ) এক প্রতিবেদনে তাঁরা বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ২ মাসে ৩০টি গণপিটুনির ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০ জন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৭ মাসে গণপিটুনির অন্তত ১১৪টি ঘটনায় কমপক্ষে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আর দেশে গত ১০ বছরে অন্তত ১ হাজার ৯টি গণপিটুনির ঘটনায় কমপক্ষে ৭৯২ জন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ৭৬৫ জন। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এর সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে গত ১০ বছরের এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।
মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থাটি বলছে, গত ১০ বছরের গণপিটুনির ঘটনার মধ্যে ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান ছিল সবচেয়ে ভীতিকর। গত বছরে গণপিটুনির অন্তত ২০১টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৮৮ জন। গত বছরের মতো গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটেছে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে। এই দুই বছর গণপিটুনিতে ২৩২ জন নিহত হন। বিশেষ করে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে অন্তত ৩০টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১৯ জন আর আহত হয়েছেন ২০ জন।
জানা যায়, দেশে গণপিটুনির ঘটনা আগে ঘটলেও গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ ধরনের ঘটনা নতুন মাত্রা পায়। আগে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা বেশি ঘটলেও এ সময় দলবদ্ধভাবে হামলার ঘটনা বেড়েছে, যা ইতিমধ্যে ‘মব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপর এ ধরনের ঘটনাকে মানুষের রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেন অনেকে। তবে ছয় মাস পর এসেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অধিকারকর্মীরা এ জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন।
- ৭ মাসে গণপিটুনির ১১৪টি ঘটনায় কমপক্ষে ১১৯ জন নিহত
- ১০ বছরে ১ হাজার ৯টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৭৯২ জন
- মামলা হলেও সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের উদাহরণ কম
- যথাযথ ভূমিকা পালনের আহবান এইচআরএসএস’র
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যায়, গত ৩ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের এওচিয়া ইউনিয়নে মাইকে ‘ডাকাত’ঘোষণা দিয়ে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে মাদারীপুরে ডাকাতির ঘটনায় শরিয়তপুরে গণপিটুনির ঘটনায় ৫জন নিহত, ২৭ ফেব্রুয়ারি উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টোকরে ঝুলিয়ে রাখা, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর গুলিস্তানে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি নিহত, ২০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম মোল্লা নামে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা, ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা, ৭ সেপ্টেম্বর গণপিটুনিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে হত্যাসহ ডাকাত বা চোর সন্দেহে, ধর্মীয় অবমাননা, ছেলেধরা বা কল্লাকাটা অভিযোগে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে।
যেসব এলাকায় গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে বেশি
এইচআরএসএস’র তথ্য বলছে- সম্প্রতি বগুড়া, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, চট্ট্রগ্রাম, খুলনা, মিরসরাই, যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, রাজশাহী ও বরিশালে এমন গণপিটুনির ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা বা এফআইআর হলেও সুষ্ঠু তদন্ত বা অপরাধীদেরকে শাস্তি নিশ্চিতের ঘটনা খুবই কম। এসব ঘটনায় দোষীরা আইনের আওতায় না আসায় দীর্ঘদিন ধরে এক ধরণে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, ফলে দোষীরা অধরাই রয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের আইনের আওতায় বিচার লাভ এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। সংবিধানের ২৭, ৩১, ৩৩, ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না ও অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি বা ভিন্ন কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দণ্ডবিধির ১৮৭, ৩১৯, ৩২৩, ৩৩৫ ও ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। গণপিটুনিতে কোন ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেয়া সকল ব্যক্তি সমানভাবে দায়ী হবে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী, গণপিটুনি মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা-১৯৪৮, এর তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার আছে। অনুচ্ছেদ পাঁচ অনুযায়ী- কারো প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না। আর নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি- ১৯৬৬ এর অনুচ্ছেদ ছয় একই বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছে। অনুচ্ছেদ ৭-এ নির্যাতনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
যথাযথ ভূমিকা পালনের আহবান এইচআরএসএস’র
এইচআরএসএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তাঁকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে ওই ঘটনায় অংশগ্রহণকারী সব ব্যক্তি সমনাভাবে দায়ী থাকবেন। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কারও প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক আচরণ করা যাবে না।
এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান, দেশের আইন ও আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী গণপিটুনি একটি দন্ডনীয় অপরাধ এবং মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) দেশের সকল নাগরিককে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে আহবান জানাচ্ছে। গণপিটুনির মতো ঘটনা এড়াতে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের সকল নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে ও গণপিটুনির সাথে সম্পৃক্ত সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে এবং এলাকাভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় সামনে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের সচেতন সমাজ ও গণণমাধ্যমকে গণপিটুনির বিষয়ে দেশের সকল নাগরিককে সচেতন করে গড়ে তুলতে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)।
কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে