কাঠগড়ায় ‘নির্বাক’ শামসুদ্দিন চৌধুরী, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘হাসতে’ চান শাজাহান খান

প্রকাশিতঃ 10:35 pm | March 05, 2025

আদালত প্রতিবেদক, কালের আলো:

বিভিন্ন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক; সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান; সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ ১৬ জনকে সাত সকালেই আদালতে হাজির করা হয়েছে। বুধবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে আটটার দিকে তাঁদের বিভিন্ন কারাগার থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে হাসিমুখে দেখা গেছে সাবেক আইনমন্ত্রী ও নৌপরিবহন মন্ত্রীকে। তবে আদালতের কাঠগড়ায় ‘নির্বাক’ দাঁড়িয়ে ছিলেন শামসুদ্দিন। গুলশান থানায় করা আরজু শেখ হত্যা মামলায় তাকে এদিন আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে পুলিশ। আদালত শুনানি নিয়ে তাঁর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড মঞ্জুর হলে মাথা নিচু করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন শামসুদ্দিন চৌধুরী। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পরামর্শে রিমান্ডের বিরোধীতা করে তিনি কোন কথা বলেননি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এদিন সকালে হাজতখানা থেকে বের করার সময় সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দুই হাত পেছনে নিয়ে পরানো হয় হাতকড়া। তাঁকে আদালতের হাজতখানার ভেতর থেকে হাঁটিয়ে সামনে আনা হয়। তখন সময় সকাল ৯টা ৫৯ মিনিট। তাঁর মাথায় হেলমেট। বুকে পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। দুই হাত পেছনে, পরানো হাতকড়া। তাঁর সামনে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আনিসুল হকের সামনে ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। দোতলায় আদালতকক্ষের সামনে তাঁদের যখন নেওয়া হয়, তখন আদালতকক্ষে আইনজীবী ও পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। প্রথমে আতিকুল ইসলামের মাথা থেকে পুলিশের হেলমেট খোলা হয়। এরপর আনিসুল হক, শামসুদ্দিন চৌধুরীদের মাথার হেলমেট খোলা হয়। এরপর একে একে তাঁদের নেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ায়। কাঠগড়ায় নেওয়ার পর শামসুদ্দিন চৌধুরীর পেছনের দুই হাত থেকে এক হাতের হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়। তখনো তিনি তাঁর দুই হাত পেছনে রেখে বিমর্ষ মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন।

শামসুদ্দিন চৌধুরীর ঠিক বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আনিসুল হক। আনিসুলের বাঁ পাশে ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। আনিসুল ও তাজুল দুজনই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকেন। সময় তখন সকাল ১০টা ৭ মিনিট। বিচারক তখনো এজলাসে আসেননি। আনিসুলের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন একাত্তর টিভির সাবেক সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা রুপা। আনিসুল হক ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে থাকেন।

পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছিলাম, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর মানিক দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিচারপতি মানিকের একটি ছবিও দেখেছিলাম। তিনি কলাপাতার ওপর শুয়ে ছিলেন। পরনে ছিল তাঁর হাফপ্যান্ট। গায়ে কাদামাটি।’

বিচারকের উদ্দেশে পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন আমলে এই বিচারপতি মানিক তাঁর পক্ষ নিয়ে টক শোতে কথা বলেছেন দিনের পর দিন। এমনকি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতনের পক্ষেও তিনি সাফায় গেয়েছেন। তিনি টক শো উপস্থাপককেও ধমকি দিয়েছেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী।’

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসতে চান শাজাহান খান
আদালতে তোলার আগে ও পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা হয় শাজাহান খান, সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও সোলাইমান সেলিম। এসময় শাজাহান খানকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করেন এক সাংবাদিক। উত্তরে তিনি বলেন, আছি তোমাদের দোয়ায়। দোয়া করবা আমার জন্য। তখন ওই সাংবাদিক বলেন, কী দোয়া করব? উওরে শাজাহান খান বলেন, দোয়া করবা যেন তাড়াতাড়ি মুক্তি পেয়ে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং আগামী নির্বাচনে কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারি, এ সমস্ত কারণে দোয়া করবা। তখন ওই সাংবাদিক আবার বলেন, সবাই বলছে আপনারা দেশের বারোটা বাজিয়েছেন। তখন শাজাহান খান বলেন, আমরা বারোটা বাজিয়েছি না কারা বারোটা বাজিয়েছে এটা সামনে প্রমাণিত হবে।

শুনানি শেষে গারদখানায় নেওয়ার সময় আরেক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি এত হাসেন কেন। তখন শাজাহান খান বলেন, আমি সবসময় হাসি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাসতে থাকব। এরপর কারাগারে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, খুব ভালো আছি। কারাগারে থেকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিরাপদে আছি।

শুনানির একপর্যায়ে ফারজানা রুপা আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চান। এসময় আদালতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমার পক্ষে কথা বলার জন্য আইনজীবী নেই। আমি কি আমার জামিনের পক্ষে কথা বলতে পারব? এসময় বিচারক বলেন, এখানে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হচ্ছে, জামিনের শুনানি হচ্ছে না। এরপর ফারজানা রুপা বলেন, মামলা তো ডজন খানেক গড়াচ্ছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটা হত্যা মামলাই তো যথেষ্ট। পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মনিরুল ইসলাম তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখান। এসময় আসামির ডকে থাকা অবস্থায় শাকিল ও ফারজানা একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা করেন।

এদিকে, কাঠগড়ায় ওঠে সোলাইমান সেলিম এক আইনজীবীকে ডেকে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে থাকেন। কথা বলার সময় আইনজীবী সোলাইমান সেলিমের কাছে কারাগারে কেমন জীবন কাটাচ্ছেন জানতে চান। এসময় সোলাইমান সেলিম বলেন, রোজা আছি। বই পড়ি। পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলা যায়। সেহরি ও ইফতারে খাবার নরমাল দেয়। দেখছেন না সবার মুখ কেমন শুকনো। কিছুক্ষণ পরই এজলাসে বিচারক আসেন। তবুও কর্ণপাত করেন না সোলাইমান সেলিম। সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে সোলাইমান সেলিম বলেন, অনেক সাংবাদিক ভুয়া নিউজ করে। তারা লিখেছে শাজাহান খানসহ অনেকে নাকি কারাগারে ভালো খাবার খাচ্ছে। এসব ভুয়া নিউজ করে আমাদের অবস্থা খারাপ করছে। এসময় পুলিশ সদস্যরা তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে বারণ করেন। তখন সোলাইমান সেলিম পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘জবাই তো দেবেন। একটু সময় দেন।’ এরপরই ক্ষোভ প্রকাশ করে সোলাইমান সেলিম আইনজীবীকে বলেন, ‘যেকোনো সময় ফাঁসির আদেশ আসতে পারে। এতে আমি অবাক হব না। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যেভাবে ভাঙা হয়েছে। বোঝা শেষ।’

কালের আলো/আরআই/এমএইচ