আমার শহরে এসেছে মেয়েটা…

প্রকাশিতঃ 12:15 pm | March 10, 2025

আমীন আল রশীদ:

‘মেয়ে বড় হইতে থাকলে বাপের দুশ্চিন্তা বাড়ে। মেয়েরে সাবধানে রাখবা।’ আমার একমাত্র মেয়ের প্রথম জন্মবার্ষিকীতে এসে একজন আত্মীয় এই পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও দুটি কন্যা সন্তানের বাবা।

আমার মেয়ের বয়স এখন ১০ বছর। তিন বছর পরেই সে কৈশোরে পা দেবে। ১৩ থেকে ১৯—মেয়েদের এই বয়সটা যে কতটা ‘বিপজ্জনক’ এবং বাবা মায়ের জন্য কতটা উদ্বেগের— সেটি যাদের কন্যাসন্তান নেই, তাদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। হয়তো আমি এখনও বুঝতে পারছি না। কেননা মেয়ের বয়স এখনও ১৩ হয়নি। কিন্তু এখনই আমার ভেতরে নানাবিধ ভয় ও শঙ্কা কাজ করে। তার মা তাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলে দুশ্চিন্তায় থাকি। যখন আরেকটু ছোট ছিল, তখন গ্রামে গেলে ভয় পেতাম পানিডে ডোবার। কেননা আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুকুর এবং আশেপাশে অনেক খাল ও নদী রয়েছে। কিন্তু পানিতে ডোবার ভয় এখন নেই। কারণ সে বোঝে, যেহেতু সাঁতার জানেনা, অতএব পানির খুব কাছে একা যাওয়া যাবে না— এটুকু কাণ্ডজ্ঞান তার হয়েছে। কিন্তু এখন ভয় অন্য। কী সেই ভয়, সেটি আপনিও জানেন।

২০২২ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবারেই ৯৫ শতাংশ শিশু নির্যাতনের শিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরের বাইরে বা অন্য যেকোনোখানে শিশুরা যতটা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে নিজ পরিবারে। বিশেষ করে মা-বাবা ও অভিভাবকদের দ্বারা। শারীরিক নির্যাতনের বাইরেও শিশুদের নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। যেমন শিশুকে ছোট করা, আজেবাজে নামে ডাকা, ভয় দেখানো, গালাগাল করা, ধমক দেওয়া, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা করা, সামাজিকভাবে হেয় করা, অভিশাপ দেওয়া, লজ্জা দেওয়া, অবহেলা করা ইত্যাদি। এই হয়রানিগুলো শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।

কেউ যখন ধর্ষণ করে বা ধর্ষক হয়ে ওঠে, এমনকি কেউ যখন রাস্তায় কোনো অপরিচিত নারীর পোশাক নিয়ে কটূক্তি করে, হেনস্তা করে, তখন সে মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি ভুলে যায়। অনেকে অবশ্য রাস্তাঘাটে নারীর পোশাক নিয়ে সবক দেয়া বা তাকে হেনস্তা করাটাকেই তার দায়িত্ব মনে করেন— যার মূলত তা অশিক্ষা অথবা বিভ্রান্তিকর শিক্ষার ফল।

গত বছরের জুন মাসে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন শিশুই প্রতি মাসে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন শিশু প্রতি মাসে সহিংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বাইরে বাংলাদেশের বাস্তবতায় কন্যাশিশুদের জন্য আরেকটি বড় ভয় ও আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ষণ—যার সবশেষ শিকার মাগুরা ও গাজীপুরের দুটি শিশু। মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পরে হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। এর একটি বড় কারণ, ওই শিশুটি পাশবিকতার শিকার হয়েছে তার পিতৃতুল্য আত্মীয়ের দ্বারা।

মামলার এজাহারের বরাতে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, চার মাস আগে মাগুরা পৌর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে শিশুটির বড় বোনের বিয়ে হয়। ওই বাড়িতে বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাসুর থাকতেন। বিয়ের পর থেকে বড় মেয়েকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন তার শ্বশুর। বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত পয়লা মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায় আট বছরের শিশুটি। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তার স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় শিশুটি।

রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কিন্তু বড় বোন মনে করে, শিশুটি ঘুমের মধ্যে আবোলতাবোল বকছে। এরপর সকাল ৬টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বলে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তার বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়।

এর চেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা আর কী হতে পারে? দুলাভাই দরজা খুলে দিয়েছে আর তার বাবা মুখ চেপে ধরে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেছে! একুশ শতকে, একটি সভ্য দুনিয়ায়, সভ্য রাষ্ট্রে এই ঘটনা সম্ভব? বাবা ধর্ষক আর ছেলে তার সহযোগী! এর কী ব্যাখ্যা আছে? তারা কী মানসিকভাবে সুস্থ, বিকারগ্রস্ত, উন্মাদ না পশু? আপন বোনের বাড়িতেও যে শিশুটি নিরাপদ নয়, ঘরের বাইরে তার নিরাপত্তা কে দেবে?

কাছাকাছি সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে গাজীপুরের শ্রীপুরে। যদিও মাগুরার ঘটনার কারণে সম্ভবত এটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না। গণমাধ্যমের খবর বলছে, সেখানেও পাশবিকতার শিশুটির বয়স আট বছর। তাকে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ এবং সেই ভিডিও ধারণ করা হয়। এই অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের দরগারচালা গ্রামের শাল বনের ভেতর গত ৮ মার্চ সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। ওই রাতেই মেয়েটির মা বাদী হয়ে মামলা করেন। জনতার হাতে আটকের সময় অভিযুক্ত আরমান মিয়া দাবি করেন, ধর্ষণের ভিডিও তিনি নিজেই ধারণ করেছেন। পরে তার কয়েক বন্ধুকে পাঠিয়েছেন। তার দাবি, কয়েকজন মিলে তাকে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করিয়েছিলো। এরপর থেকে তার মাথা ঠিক ছিল না।

খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী কবীর সুমনের একটি গান:

‘আমার শহরে এসেছে মেয়েটা
হালচাল জানা নেই
বিশ্বাস করে বসলো কেন যে
তিনটি পুরুষকেই
পুরুষ কিংবা নপুংসকের রয়েছে গায়ের জোর
তিন থেকে ছয় পুরুষের জয়
ধর্ষণের রাত ভোর।’

মাগুরার শিশুটিও বেড়াতে গিয়েছিল বোনের বাড়িতে। বোনের স্বামী আর তার পিতৃতুল্য শ্বশুরই যে তার জীবন ধ্বংসের কারণ হবে, তা কি ওই শিশুটি জানতো? ৮ বছর বয়সে সে কি জানে ধর্ষণ কী? এই শব্দটার সঙ্গে সে কি পরিচিত? অথচ সারা দেশ এখন তোলপাড় তাকে নিয়ে।

বলা হয়, যখন কোনো পুরুষ ধর্ষণ করে, সে আর পুরুষ থাকে না। কেননা কোনো পুরুষ ধর্ষণ করতে পারে না। ধর্ষণ করে নপুংসকেরা। অথবা কেউ যখন ধর্ষণ করে, তখন সে আর মানুষ থাকে না। মানবিক মূল্যবোধ লুপ্ত হয়ে তার ভেতরের পাশবিকতা জাগ্রত হয়। তখন দেশের প্রচলিত আইন, ধরা পড়ার পরে সামাজিক হেনস্তার ভয় এমনকি পরকালে শাস্তির ভয়ও আর তার বিবেচনায় থাকে না। তার বিবেচনাবোধটিই লুপ্ত হয়ে যায়। যে কারণে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং অসংখ্য ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরও ধর্ষণ বা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো অপরাধ শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে না। কারণ যখন কেউ এই ধরনের অপরাধ করে, তার মাথায় বিচারের বিষয়টি কাজ করে না।

সচেতন কোনো মানুষের পক্ষে ধর্ষণ করা তো দূরে থাক, কোনো নারীর শরীরে অপরাধমূলক স্পর্শ করার সাহসও হওয়ার কথা নয়। কারণ তার মনে একধরনের ভয় ও শঙ্কা কাজ করে। প্রচলিত আইনে শাস্তি এবং পরকালের ভীতির বাইরেও মানুষ হিসেবে মানুষের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখা; নীতি-নৈতিকতা মেনে চলার বিষয়টিও এখানে বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কেউ যখন ধর্ষণ করে বা ধর্ষক হয়ে ওঠে, এমনকি কেউ যখন রাস্তায় কোনো অপরিচিত নারীর পোশাক নিয়ে কটূক্তি করে, হেনস্তা করে, তখন সে এইসব মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি ভুলে যায়। অনেকে অবশ্য রাস্তাঘাটে নারীর পোশাক নিয়ে সবক দেয়া বা তাকে হেনস্তা করাটাকেই তার দায়িত্ব মনে করেন— যার মূলত তা অশিক্ষা অথবা বিভ্রান্তিকর শিক্ষার ফল।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।