দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে চায় ঐকমত্য কমিশন
প্রকাশিতঃ 2:57 pm | March 10, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
দ্রুত রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের বিষয়ে আলোচনা করে ঐক্যমতে পৌঁছাতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছে ‘জাতীয় সনদ’ও তৈরি করতে চায় এই কমিশন।
সোমবার (১০ মার্চ) জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা ও গ্রহণ করার লক্ষে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো ছক আকারে বিন্যস্ত করে সেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর কাছে মতামত জানতে চেয়েছে জাতীয় ঐক্যমত কমিশন। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো তাদের মতামত দিলে সেটি নিয়ে আলোচনা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে চাই।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আলী রীয়াজ বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে প্রায় ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে ৫ আগস্ট; শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পলায়ন করতে বাধ্য হন।
এ প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ সংস্কারের জন্যে গঠিত ছয়টি কমিশন তাদের সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদনগুলো সরকারের কাছে জমা দেয়।
তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই ছয়টি কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং পদক্ষেপ সুপারিশের উদ্দেশ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এই কমিশনের সভাপতি।
এ কমিশনে সহসভাপতির দায়িত্ব আমার (আলী রীয়াজ) ওপরে অর্পণ করা হয়। এ কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফররাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক এবং ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ কমিশনের মেয়াদ ছয় মাস। কমিশনের কাজে সহযোগিতা করার উদ্দেশে গত ৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে সাংবাদিক মনির হায়দারকে নিয়োগ করা হয়। তিনি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা আলী রীয়াজ আরও বলেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এই কমিশন কাজ শুরু করে। কমিশনের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে ওই দিন প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সৌজন্য সভা হয়। এই সভায় ৩৪টি দলের মোট ১০৪ জন প্রতিনিধি অংশ নেন।
সভায় উপস্থিত সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে তাদের সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ওই সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের হার্ড কপি ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। আগে সব দলকে প্রতিবেদনগুলোর সফট কপিও প্রেরণ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এরপরে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তিন দফা বৈঠকে মিলিত হন এবং সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর প্রতিবেদনগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোকে চিহ্নিত করেন। পরে পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহকে ছকের আকারে বিন্যস্ত করা হয়। এসব ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যুক্ত করা হয়নি। কারণ, পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে, তাদের সুপারিশসমূহ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।
আলী রীয়াজ আরো বলেন, ছকসমূহ গত ৬ মার্চ ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এতে মোট সুপারিশের সংখ্যা হচ্ছে ১৬৬টি। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি; নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ ২৭টি; বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি; জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি; এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি। প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে।
সেগুলো হলো-‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
দ্বিতীয়টি হলো প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এ ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’ ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।
জাতীয় ঐক্যমত কমিশনর সহ সভাপতি আরো বলেন, আমরা আশা করছি, আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো তাদের মতামত আমাদেরকে জানাবেন। দলগুলোর কাছ থেকে তাঁদের মতামত প্রাপ্তি সাপেক্ষে আমরা দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করবো। এজন্য এখনো পর্যন্ত আমরা কোন সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারন করিনি। যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে সেই সময় থেকেই আলোচনার শুরু হবে। আমরা রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোর প্রতি যত দ্রুত সম্ভব মতামত জানাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। এই প্রক্রিয়ার পরের ধাপ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই দ্রুত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে।
তিনি আরো জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ব্যাপারে নাগরিকদের মতামত জানার জন্যে খুব শিগগিরই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হবে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে অবহিত করা হবে।
সুপারিশগুলোর বিষয়ে কতটি দল একমত হলে সেটি ঐক্যমত ধরা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, সংখ্যাই কেবল বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা আশা করছি, অধিকাংশ প্রস্তাবের বিষয়ে অধিকাংশ দলই একমত হবেন। সেটা হলে সবচেয়ে ভালো হবে আমাদের জন্য। কাজটি সহজ হবে, খুব সহজেই আমরা অগ্রসর হতে পারবো। কিন্তু সংখ্যার বিবেচনা যেমন আছে, তেমনি এটাও বিবেচনা করতে হবে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং ভিন্ন ভিন্ন শক্তির প্রভাব বিভিন্নভাবে সমাজে আছে। আমাদের এটাও বিবেচনা করতে হবে। কাজেই আমরা পূর্ব নির্ধারিত ধারণা নিয়ে এখনই অগ্রসর হচ্ছি না। এগুলোর গুরুত্বকে আমরা বিবেচনা করবো। আমরা বার বার বলছি, আমরা আলাপ আলোচনা করবো। কেবল টিক চিহ্নের ওপর নির্ভর করছি না। আমরা মনে করি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা অনেক বিষয়ে একমত হতে পারবো। সেক্ষেত্রে সংখ্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলকে যদি আমরা একমত করতে পারি, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে।
সুপারিশের বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে সময় লাগলে, সেটি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ফলে নির্বাচনের যে সময়সূচি তৈরির চেষ্টা চলছে, ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে। ফলে সংস্কার কমিশনের কাজ বা ঐকমত্য কমিশনের কাজের কারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ আমি দেখি না।
এ সময় ড. বদিউল আলম মজুমদার, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফররাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক ও ড. ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এমডিএইচ