প্রধান উপদেষ্টার পরিস্কার বার্তা আশা জাগিয়েছে পুলিশে

প্রকাশিতঃ 7:36 pm | March 17, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন দমন করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাপক জনরোষে পড়ে পুলিশ। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অভিযোগে বাহিনীটির ওপর ক্ষুব্ধ ছিল দেশের বেশিরভাগ মানুষ। এই অবস্থায় ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলে বড় ধাক্কা খায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি। জনরোষে দেশের বেশিরভাগ থানা কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা বাহিনীটির চেইন অব কমান্ড। থানায় থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ, মারধর ও হত্যার ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি পড়া বাহিনীটির অনেক সুবিধাভোগী কর্মকর্তা জনরোষ থেকে বাঁচতে চলে যান আত্মগোপনে। আবার অনেকে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় থানা ফিরতে শুরু করে পুলিশ। উদ্ধার হতে থাকে পুলিশের লুট হওয়া বন্দুক ও গুলি। জনগণের আস্থা ফেরানোর পাশাপাশি হারানো মনোবল ফেরাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রথমেই পরিবর্তন আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। তিনি দায়িত্ব পেয়েই পুলিশকে নতুনভাবে সক্রিয় ও কাজের গতি বাড়াতে পূর্ণদ্যোমে মনোনিবেশ করেন। এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ডিএমপি কমিশনারসহ ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বাহিনীটিকে পেশাদার ও জনমুখী করতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। চলমান রয়েছে পুলিশে সংস্কার প্রক্রিয়াও। কিন্তু এরপরেও বাহিনীটির সদস্যরা স্বরূপে না ফেরায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা বিরূপ আচরণের শিকার হন। গত ৬ মাসে পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটে। আইন প্রয়োগ করতে আক্রমণের শিকার হওয়ায় মনোবল ভাঙতে শুরু করে পুলিশের।

এমন সময়ে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (১৭ মার্চ) পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের ১২৭ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। পরিস্কার বার্তায় বলেছেন, ‘পুলিশকে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে দেশ গড়া যাবে না। পুলিশই সম্মুখসারির মানুষ। পুলিশ মানে আইন ও শৃঙ্খলা। আর এই আইন ও শৃঙ্খলা না থাকলে যত বড় বড় চিন্তাই হোক, যত টাকাই ঢালুক, কোনো কাজে আসবে না।’

  • পুলিশকে অবহেলা করে বা পাশ কাটিয়ে দেশ গড়া যাবে না
  • আইন হলো সবার আশ্রয়, পুলিশ হবে সেই আশ্রয়দাতা
  • বাংলাদেশ দুনিয়ার মাঠে খেলার খেলোয়াড়, ছোট মাঠে খেলার খেলোয়াড় না

বিভিন্ন সময়ে পুলিশের ওপর হামলা ও আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণের মাধ্যমে পুলিশের প্রতি বিরূপ আচরণের ঘটনা আলোচনা তৈরি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে এটি পুলিশ সদস্যদের জন্য বড় এক অন্তরায়। তুঙ্গে থাকা এই আলোচনার মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.ইউনূস সাফ সাফ বুঝিয়ে দিলেন পুলিশকে অবহেলা করে দেশ গড়া একেবারেই অসম্ভব। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই বিশ্বনেতার কণ্ঠে এমন সময়োপযোগী উচ্চারণ পুলিশ সদস্যদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করবে। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরও আত্মবিশ্বাস জোগাবে। হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে যেটি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘সরকার যা কিছুই করতে চাক না কেন, যে ভঙ্গিতেই করতে চাক না কেন, শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাত দিয়েই করতে হয়। তারা সম্মুখসারির মানুষ। করে দেবে না, তারা এনভায়রনমেন্টটা (পরিবেশ) সৃষ্টি করে। এনভায়রনমেন্ট না থাকলে কোনো কাজ হয় না।’

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রতিটি সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকা যে অপরিহার্য সেই বিষয়টিও পরিস্কার করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘পুলিশের কথার প্রসঙ্গে বারবার আমরা বলেছি দুটি কথা আইন ও শৃঙ্খলা, এটাই হলো পুলিশ। … পরিবেশ সৃষ্টি করা। আইনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আইন যদি না থাকল তাহলে সরকারই কী, গণতন্ত্র কী, অধিকার কী, নাগরিকদের কী, কিছুই থাকে না। এটাই ছিল মূল জিনিস। আমরা পুলিশকে অবহেলা করে, বা পাশ কাটিয়ে গিয়ে দেশ গড়তে পারব না। তারাই সম্মুখসারির মানুষ। তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করলে তখন বাকি জিনিসগুলো হয়। বীজ লাগানো হয়, চারা লাগানো যায় সবকিছু হয়। আইন না থাকলে ও শৃঙ্খলা না থাকলে যত বড় বড় চিন্তাই হোক, যত টাকাই ঢালুক, কোনো কাজে আসবে না।’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সম্ভাবনার পরিবেশ যেন হারিয়ে না যায় সেই বিষয়েও আলোকপাত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশ একটি মস্ত বড় সম্ভাবনাময় দেশ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তবে সেই সম্ভাবনাকে আমরা বাস্তবের দিকে আনতে পারছি না, ঠেকে যাচ্ছি। আজকে আমরা যে সুযোগ পেয়েছি, মস্ত বড় সুযোগ। সে সম্ভাবনাকে কার্যে পরিণত করা। এবং জুলাইয়ের এ অভ্যুত্থানের ফলে সেই সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্ভাবনার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। কারণ হারিয়ে ফেলা সোজা। মুহূর্তে হারিয়ে যায়। এ সম্ভাবনাকে ধরে রাখা। যেটুকু সময় আমাদের আছে, এর মধ্যে আমরা চেষ্টা করব, ভবিষ্যতে যারা আসবে, তারাও আশা করি চেষ্টা করবে, পথটা যেন আমরা সৃষ্টি করে দিই, এই পথে আমরা এগোলে সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে পরিণত হবে।’

পুলিশকে সবসময় ক্ষমতাসীন দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এই বাহিনীর সদস্যরা জনগণের সেবক ভাবার পরিবর্তে নিজেদের প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী ভেবেছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন বিগত ১৫ বছরে পুলিশে পদোন্নতিতে দলীয় পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছে। অপাংক্তেয়রা ফ্রন্টলাইনে এসেছে। এই সুযোগে প্রভাব দেখিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটানো, বাসা থেকে ধরে এনে মারধর, ঘুষ দাবি, রাজনৈতিক সভা সেমিনারে বাধা দেওয়াসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ধ্বংস করা হয় বাহিনীটির ভাবমূর্তি। ফলে ছাত্র-জনতার হাত ধরে নতুন বাংলাদেশে ব্যাপক জনরোষে পড়তে হয় বাহিনীটিকে। প্রধান উপদেষ্টার চোখেও পুলিশের ওই সময়টি অন্ধকার যুগ। তবে সরকারি হুকুম-নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তাঁরা কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। এতে পতিত সরকারের পাশাপাশি পুলিশেরও দায় দেখছেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশকে আহ্বান জানিয়েছেন ওই অন্ধকার যুগের চিন্তা-ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার।

নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নতুন পরিবেশ সৃষ্টিতে পুলিশের একটি বড় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। পুলিশ বাহিনীর মুশকিল হলো ওই অন্ধকার যুগের তারা একটিভ পার্টিসিপেন্ট (সক্রিয় অংশগ্রহানকারী) ছিল। নিজের ইচ্ছায় না, সরকারি কাজ করতে গিয়ে, হুকুম পালক করতে গিয়ে এমনটা করতে হয়েছে। কাজেই এখন নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার জন্য তাঁদের ওই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে পুলিশকে জনসাধারণের ‘বন্ধু’ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা (পুলিশ) নুতন বাংলাদেশ গড়ব। আমাদের অনেকে দোষ দেয়। আমরা মানুষ খারাপ না। আমরা খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়েছিলাম। আমরা এই খারাপ মানুষ থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমরা ভালো মানুষ। আমরা দেখ কী করতে পারি। সেই দৃঢ় চিন্তাটা মাথায় রাখতে হবে যে আমরা দেখিয়ে ছাড়ব। আমাদের কাজের মাধ্যমে আমরা দেখাব, আমাদের হাত দিয়ে এই নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে, আমরা তাতে বড় একটা ভূমিকা পালন করব। আমাদের কাছেই আছে আইন এবং শৃঙ্খলা। এটা আমরা প্রতিষ্ঠা করব।…পুলিশ হবে বন্ধু। আইন হলো সবার আশ্রয়। পুলিশ হবে সেই আশ্রয়দাতা। সেই ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নতুন করে যে যাত্রা শুরু হলো, এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ, এই সুযোগটাকে যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি। সুযোগগুলো তৈরির একটি পরিবেশ লাগে। সেখানে পুলিশ বাহিনী এক মস্ত বড় ভূমিকা পালন করে। আইন ও শৃঙ্খলা। আইনটা যদি আমরা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি, শৃঙ্খলা যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তাহলে যেকোনো কোনো যুদ্ধ জয় করা সম্ভব।’ পুলিশকে উজ্জীবিত করে নতুন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর করণীয় বিষয়সমূহ তুলে ধরেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘অতীত নিয়ে কান্নাকাটি করার দরকার নাই। নতুনের জন্য আমরা প্রস্তুত এবং করে দেখাব। এটা মুখে বলার দরকার নেই। কাজে বলব, যে হ্যাঁ এই হলো নতুন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী। সবাই বাহবা দেবে যে হ্যাঁ, এই একটা কাজ এবং আশপাশের যারা আছে, তারা বলবে যে ভাই, আপনারা একটা কাজ দেখালেন। এটা আমরা চিন্তা করি নাই, পুলিশের হাত দিয়ে এই কাজ হতে পারে। পুলিশের মাথায় চিন্তা আসতে পারে। কারণ, পুলিশ সম্বন্ধে ইমেজ হলো যে তারা খারাপটাই আগে দেয়। খারাপটা আগে করে। আমরা ভালোটা আগে দেখব, ভালোটা আগে করব। আমাদের পুরো বাহিনীটা নিয়োজিত।

দুনিয়ার মাঠে খেলার টিমে পুলিশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
‘বাংলাদেশ দুনিয়ার মাঠে খেলার খেলোয়াড়, ছোট মাঠে খেলার খেলোয়াড় না। স্বপ্নের, সাধের বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে দলবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে হবে। টিমওয়ার্ক জরুরি এবং বাংলাদেশে যতগুলো টিম আছে তার মধ্যে পুলিশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা দুনিয়ার মাঠে খেলার খেলোয়াড়, আমরা ছোট মাঠে খেলার খেলোয়াড় না বাংলাদেশ, ওই যে বললাম, বাংলাদেশ অপূর্ব একটা দেশ। সে দেশে যারা আমরা দুনিয়ার মাঠে খেলি। আমাদের দেখে লোকে হাততালি, এরা এসেছে। বাংলাদেশ নেমেছে এবার। ওরকম চাই, ওরকম এবং করতে পারি।…আমরা বাস্তবে পারি। আমাদের সে সুযোগ আছে। সেই সুযোগের কথা বারে বারে বলার চেষ্টা করছি। এই সুযোগগুলো যেন আমরা গ্রহণ করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাহিনী সামগ্রিকভাবে একটা কাঠামো। এই কাঠামোর কাছে অনেক শক্তি, যদি আমরা সেই শক্তিকে ঠিক দিকে প্রসারিত করি। যেটি বলার জন্য, যে কমিউনিকেট করার জন্য যে আমরা এই সুযোগটা গ্রহণ করি। আমরা কী কী করলে হবে, সেই আলোচনাটা আমরা শুরু করি। যে এই এই জিনিস হলে, এটা একটা টিম ওয়ার্ক। তো এটা একক উপদেষ্টা হুকুম দিয়া দিল আর তোমরা করে ফেললে, এ রকম না। এটা সবাই মিলে একটা টিমের মতো খেলতে হবে এবং বাংলাদেশে যত টিম আছে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিমগুলো তোমরা, ‘পুলিশ বাহিনী’।

কালের আলো/এমএএএমকে