দায়িত্বশীলতায় উজ্জ্বল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা
প্রকাশিতঃ 10:45 am | April 14, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফল গণঅভ্যুত্থানের পর এতে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের চাওয়া মেনে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর তখন ধ্বংসপ্রায় অবস্থা। আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়ে। এরপর শান্তিতে নোবেল জয়ী ড.ইউনূসের নেতৃত্বে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের উপদেষ্টাদের হাত ধরেই রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন বুনে দেশের সাধারণ মানুষ।
সরকারপ্রধানের মতো কয়েকজন বাদে অন্য সব উপদেষ্টারাই নিজেদের ৮ মাস সময় পূর্ণ করেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন। পাশাপাশি নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনেও দায়িত্বশীলতা, মেধা, যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এতে করে তাদের প্রতিও সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। তাদের পারফরম্যান্স বিচার বিবেচনা করতে ৮ মাস সময় যথেষ্ট না হলেও তারপরও এই সময়ে তারা কী করেছে না করেছে তার দিকে নজর রয়েছে সবার। দৃষ্টি রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থারও। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে প্রতিনিয়ত তারা লড়াই করেছেন। তারা অসফল হওয়া মানেই শত মানুষের রক্ত ও ত্যাগে অর্জিত এই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে, যা কারও কাম্য হতে পারে না। তাই দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এই সরকারকে সফল করতে প্রতিটি উপদেষ্টা নিজেদের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ আমাদের এই বিশেষ প্রতিবেদনে থাকছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ৫ উপদেষ্টার কর্মতৎপরতা। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য উপদেষ্টাদের নিয়েও প্রতিবেদন থাকবে কালের আলো.কম এ।
ড.আসিফ নজরুল
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল কর্মগুণেই আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর আন্তরিকতায় দ্রুততম সময়ে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য অধ্যাদেশ প্রণয়ন সম্ভব হয়েছে। আর বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপের সফল বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় তৈরির বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় বিশাল অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রস্তুতের কাজও প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে।
রাউন্ড দ্য ক্লক সক্রিয় সরকারের অন্যতম নীতি নির্ধারক এই উপদেষ্টা ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে রাজনৈতিক হয়রানিমূলকভাবে দায়ের করা ৭ হাজার ১৮৪টি মামলা আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছেন। এই সময়ে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে দায়েরকৃত প্রায় সকল ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো চিহ্নিত করে প্রত্যাহারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের অভিভাবকত্বে সাফল্যের সঙ্গেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। স্বৈরশাসকের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়েও তিনি ছিলেন ‘চির উন্নত মম শির’। দুটি মন্ত্রণালয় পরিচালনায়ও তার পারফরম্যান্স নজরকাড়া। সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী এই উপদেষ্টা দেশব্যাপী তারুণ্যের উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। নিজের দুটি মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুন্য সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করেছেন। সরকারকে ব্যর্থ করতে সব অপতৎপরতা রুখে দিতে তিনি সজাগ-সতর্ক রয়েছেন। ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় সব ষড়যন্ত্রের ব্যুহ ভেদ করেছেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
বায়ুদূষণ রোধে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় আদালত ও মাঠে সমানতালে লড়াই চালিয়েছেন দেশের স্বনামে খ্যাত পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই মনোনিবেশ করেছেন দীর্ঘ সময়ের জঞ্জাল সাফে। তিনি বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও পানি দূষণ প্রতিরোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সরকার, গণমাধ্যম এবং জনগণকে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বায়ুদূষণের চূড়ায় থাকার দীর্ঘদিনের দুর্নাম ঘুচিয়ে রাজধানীকে নির্মল করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি ২০০২ সালে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপরতা শুরু করেন। নতুন বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ রক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন। দেশের কাঁচাবাজারসহ খোলাবাজারে গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পলিথিন উৎপাদন বন্ধ, কাঁচাবাজার, সুপারশপেও পলিথিন নিষিদ্ধের বিষয়ে আগে থেকেই ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর না হওয়ায় অ্যাকশনে যায় তার মন্ত্রণালয়। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব চটের বা পাটের ব্যাগকে প্রমোট করেছেন তিনি। তাকে নিয়ে আশার মালা গেঁথেছেন দেশের মানুষ।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
দেশের জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার দায়িত্ব অর্পিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঁধে। এই পদে দায়িত্ব পালন করা যে কারও জন্য অনেক বেশি চাপের ও চ্যালেঞ্জের। বিশেষ করে যেকোন দেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নাজুক আইনশৃঙ্খলা থেকে উত্তরণ ঘটানো সহজ নয় মোটেও। আর এই কঠিন কাজটিই একদিন-প্রতিদিন করে চলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো.জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ব্যক্তিজীবনে একজন সরল মানুষ হিসেবেই তিনি পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর আকস্মিক থানা ভিজিট কার্যক্রম ও লাল গালিচার মাধ্যমে তৈলমর্দন নীতির কড়া সমালোচনা করে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। তিনি থানাগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে চলছে কীনা এটি পর্যবেক্ষণেই কোন আওয়াজ না দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। জনগণ যেন নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারেন ও নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেটা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন।সরকারের প্রভাবশালী আইন উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুলও সম্প্রতি চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রার টকশোতে তার কর্মতৎপরতার প্রশংসা করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসে আইনশৃঙ্খলায় স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা বর্তমানে অনেকটাই কমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অনেকটাই কমে এসেছে খুন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও মব সন্ত্রাসের মতো ঘটনা। এছাড়া এই বছর রমজান ও ঈদের ছুটিতেও জনমনে ছিল স্বস্তি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক থাকলেও দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উল্লেখ করার মতো অপরাধমূলক কোনো ঘটনা ঘটেনি। অন্যান্য সময় রোজা ও ঈদকে ঘিরে কমবেশি আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। মৌসুমি অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু এবার তেমনটি ঘটেনি। পাশাপাশি দেশে প্রথমবারের মতো নির্বিঘ্নে ঈদ যাত্রার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ পাকা জহুরির মতোই সম্পাদন করে চমক দেখিয়েছেন এই উপদেষ্টা।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন
নৌপরিবহন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে না থেকে প্রতিনিয়ত ছুটছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের অন্যান্য বন্দরে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান করেছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির সব সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়েছেন। এসবের মাধ্যমে মিলেছে আশাতীত সাফল্য। প্রথম দিকে সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশকে কাজে ফিরিয়ে আনতে বহুমাত্রিক ও কঠিন চ্যালেঞ্জে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি কাজ দিয়েই প্রমাণ করেছেন যেকোন মন্ত্রণালয়েই দায়িত্ব পালনেই তিনি পারঙ্গম। দিন-রাত একাকার করে কাজ করা অন্তর্বর্তী সরকারের পরিশ্রমী এই উপদেষ্টা এবার মনোযোগ দিয়েছেন নৌপথের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়ানো চাঁদাবাজি বন্ধের মাধ্যমে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে। তাঁর উদ্যোগে এরই মধ্যে জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তিনি বিলোনিয়া ও রামগড় স্থলবন্দরের বাণিজ্য সম্ভাবনা যাচাই করতে কমিটি করে দিয়েছেন। কথার সঙ্গে কাজের মিল রেখে পথচলা এই উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে জনআস্থা পূরণে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।
কালের আলো/আরআই/এমএএএম