গভীর সমুদ্রবন্দরের যুগে বাংলাদেশ, হাতছানি অফুরান সম্ভাবনার

প্রকাশিতঃ 11:17 pm | April 22, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

গভীর সমুদ্রবন্দরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন অবশেষে হচ্ছে সত্যি। দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি ধলঘাট এলাকায়। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে ১ হাজার ৩১ একর জায়গার নির্মাণ করা হচ্ছে এই বন্দরটি। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে ৮ থেকে ৯ হাজার টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেনার বহনকারী জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে। ফলে পণ্য নিয়ে সিঙ্গাপুর, কলম্বো আর মালয়েশিয়ার বন্দরে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না।

নির্ভরতা কমবে ওইসব বন্দরের ওপর। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে মাত্র ২৩ দিনেই সরাসরি নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের চেহারা পাল্টে দিতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে অর্থায়ন করছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর একটি হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সংস্থাটি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এবং জাপানের পেন্টা ওশান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার তোমোকাজু হাসেগাওয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আগামী ৪ বছরে ৪৬০ মিটার দীর্ঘ একটি কনটেইনার জেটি এবং ৩০০ মিটার দীর্ঘ আরও একটি মাল্টি পারপাস জেটিসহ টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দরের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ীর এই গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্যের নতুন পথ হতে যাচ্ছে। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের আঞ্চলিক কেন্দ্র হবে বলেও স্বপ্ন বুনছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এই বন্দরটি নির্মিত হলে সরাসরি বিশ্বের যেকোন জায়গায় বড় বড় জাহাজ চলে যাবে। প্রসার ঘটবে ব্যবসা বাণিজ্যের। গভীর সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করেন চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দেবে। এটি কেবল একটি অবকাঠামোগত প্রকল্প নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ।’

  • পাল্টে যাবে দেশের সমুদ্রবাণিজ্যের চেহারা
  • উন্মুক্ত দরপত্রে দুই দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসে জাপান
  • সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরের ওপর কমবে বাংলাদেশের নির্ভরতা

সাড়ে ১৪ মিটার গভীরতার কৃত্রিম এই চ্যানেলের কারণে ৮ থেকে ৯ হাজার টিইইউএস ধারণ ক্ষমতার জাহাজও সহজেই নোঙর করতে পারবে মাতারবাড়িতে। এই বন্দর বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক হাবে পরিণত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করবে জাপানি প্রতিষ্ঠান। এই বন্দর চালু হলে এই অঞ্চলে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক হাবে পরিণত হবে। সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমবে।’ এ সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ, জাপান দূতাবাসের প্রতিনিধি এবং জাইকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সমুদ্র বাণিজ্যের নতুন পথ, উন্মুক্ত দরপত্রে এগিয়ে আসে জাপান
প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো চট্টগ্রাম বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৭ সালে। ১৩৮ বছর পুরনো এই বন্দর বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। দেশের আমদানি রপ্তানির বেশিরভাগই হয় এই বন্দর দিয়ে। তবে বন্দরটির চ্যানেলের গভীরতা কম থাকায় সেখানে মাদার ভেসেল হিসেবে পরিচিত বড় আকারের জাহাজ ভিড়তে পারে না। প্রধান এই বন্দরে বর্তমানে ৩০ থেকে ৩৫ টন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ এবং ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনারকে একক সমতুল্য ধরে) ধারণ ক্ষমতার কন্টেইনার জাহাজ চলতে পারে। কিন্তু মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরে এক লাখ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার কার্গো জাহাজ এবং ৮ থেকে ১০ হাজার (টিইইউএস) কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতার মাদার ভেসেল আসতে পারবে সহজেই। প্রথম দিকে ভারত ও চীন উভয়েই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী হলেও দেখা দেয় ভূরাজনৈতিক জটিলতা। তবে শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত দরপত্রে দুই দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসে বন্ধুপ্রতীম দেশ জাপান।

মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) আনুষ্ঠানিকভাবে রাজধানীর একটি হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জাপানের দুই খ্যাতনামা নির্মাণ ও প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান পেন্টা-ওশান লিমিটেড এবং টিওএ করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির মাধ্যমে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত হলো জাপান।

  • বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত বিনিয়োগ
    ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন
    উপদেষ্টা
    নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয়

বিগত ৫ হাজার বছরের নৌ ইতিহাসে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে বহু সমুদ্র বন্দরের অভুত্থান ঘটলেও গভীর সমুদ্র বন্দরের যাত্রা এই প্রথম। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়ন হাতছানি দিচ্ছে অফুরান সম্ভাবনার। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এর নেতৃত্বের সময়েই অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি হবে দেশের অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত তিনি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এই চেয়ারম্যান বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০২৯ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি হবে আগামীর স্বর্ণদ্বার।

এই গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও নতুন গতি আসবে। ভূ-অবস্থানগত সুবিধা এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা থাকায় বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হবে। এই বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এতে করে অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। ফলে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব আয়ও বাড়বে। এখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মানের পাশাপাশি পেশারও পরিবর্তন হচ্ছে। দেশের ব্লু ইকোনমি তথা তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ। এটি দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলার যুক্ত হবে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন এবং একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে বন্দরটি।

  • এই বন্দর চালু হলে এই অঞ্চলে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক হাবে পরিণত হবে
    এডমিরাল এম নাজমুল হাসান
    বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান

সূত্র জানায়, জাপানি সংস্থাটি বন্দর নির্মাণের ‘প্যাকেজ-১’ এর অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়ন করবে। এই প্রকল্পের আওতায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস জেটি এবং ৪৬০ মিটার দীর্ঘ কনটেইনার জেটি নির্মাণ করা হবে। এছাড়া টার্মিনাল ভবন, পেভমেন্ট, সি ওয়াল, রিটেইনিং ওয়াল, ভূমি উন্নয়ন, ড্রেজিং, সৌরবিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। বন্দরটি ১৪ দশমিক ৫০ মিটার ড্রাফট ও ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মোট ৮ হাজার ২০০ টিইইউস ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ হ্যান্ডেল করতে সক্ষম হবে। ২০২৯ সালের মধ্যে ৬ লাখ থেকে ১১ লাখ টিইইউএস এবং ২০৪১ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ১৪ লাখ থেকে ৪২ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে এই গভীর সমুদ্রবন্দরে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হচ্ছে।

  • এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি হবে আগামীর স্বর্ণদ্বার
    রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান
    চেয়ারম্যান
    চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নৌ পরিবহন উপদেষ্টার
অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দরটি চালু হলে প্রায় এক লাখ ডেডওয়েট টন (ডিডব্লিউটি) ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বন্দরের ওপর চাপ কমবে, সরবরাহ শৃঙ্খলা হবে গতিশীল এবং কক্সবাজার-মহেশখালী অঞ্চলে নতুন শিল্পাঞ্চলের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। এর ফলে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি ও ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে পরিণত হবে।

এই বন্দরের ব্যয় আরও বাড়তে পারে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেন, ‘প্রকল্পের কাজে কোনোরকম দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কেউ যাতে নিজের স্বার্থ হাসিলে দেশের এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি না করে, সে বিষয়েও মনিটরিং করা হবে। ২০৩০ সালের শুরু থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম চালু হবে।’

কালের আলো/এমএএএমকে