নুসরাত হত্যা, পুলিশ বাহিনীর গায়ে ‘কলঙ্কচিহ্ন’ লেপ্টে দিতে চান কারা?
প্রকাশিতঃ 11:30 am | April 20, 2019
কালের আলো রিপোর্ট :
নৃশংসতম ও নিষ্ঠুরতম কায়দায় খুন হয়েছেন ফেনীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। প্রিন্সিপাল ও জামায়াত নেতা সিরাজ-উদ-দৌলার বিকৃত যৌন মানসিকতার শিকার হয়ে তাকে চিরতরে অকালে চলে যেতে হয়েছে।
দেশ বিদেশে চাঞ্চল্য তৈরি করা এ হত্যাকান্ড নাড়া দিয়েছে বিবেকবান প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে।
ফলশ্রুতিতে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশ। নড়েচড়ে বসে সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতের খুনিরা রেহাই পাবে না হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেন।
পুলিশের হাইকমান্ডও এ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে ‘নাটক’ ও আগুনে পোড়ানোর ঘটনাকে ‘আত্মহত্যার চেষ্টা’ বলে চালানোর চেষ্টায় ফেঁসে গিয়ে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে দু’দিনের মাথায়ই প্রত্যাহার করা হয় সোনাগাজী মডেল থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে।
স্বল্প সময়ের মধ্যেই হত্যাকান্ডে অভিযুক্ত সব আসামিকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্ত তৈরি করতে সক্ষম হয় পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা পিবিআই।
এসব ক্ষেত্রে প্রকৃত সত্যকে যেভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে এবং আসামিদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া হয়েছে তাতে প্রশংসিত হওয়ারই কথা পুলিশের!
এমনকি যৌন নিপীড়ক সেই প্রিন্সিপালের শেল্টারদাতা সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনও সর্বশেষ পুলিশের হাতে ‘ধরা’ পড়েছেন। কিন্তু মাদ্রাসাটির প্রিন্সিপাল সিরাজের লালসার আগুনে পুড়ে নুসরাতের মৃত্যুর ঘটনায় কেউ কেউ ঢালাওভাবে কেবল পুলিশকেই দোষারোপ করছেন।
এক ওসি মোয়াজ্জেম ‘অপকর্ম’ করলেও গোটা পুলিশ বাহিনীর গায়ে ‘কলঙ্কচিহ্ন’ লেপ্টে দিতেও উঠেপড়ে লেগেছেন কোন কোন বিশেষ মহল। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও।
তাঁরা বলছেন, বিশেষ মহলটি গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার পর পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত সাধারণ পুলিশ সদস্যরাই আগুন নিভিয়েছে।
মামলার প্রধান আসামি থেকে শুরু করে সব আসামিকেই দ্রুত সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।
অথচ এখনো একজনের অপকর্মের দায় দেশপ্রেমিক এই বাহিনীটির ওপর দেওয়ার অপকৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত মহল বিশেষ। পুলিশ জনগণের বন্ধু এবং সেবক হিসেবে শত শত ভালো কাজের দৃষ্টান্ত রাখলেও তাঁরা বরাবরই পুলিশকে হীন পন্থায় ঘায়েল করেই আত্মতৃপ্তিতে ভুগেন। এ মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীও দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বার বারই বলে আসছেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। কোনো পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত অপরাধের দায়ভার প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ারও নজির রেখেছেন পুলিশ প্রধান।
পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার গভর্নিং বডি সময় থাকতেই প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কমিটি উদ্যোগী হলে এ হত্যাকান্ড এড়ানো সম্ভব ছিলো।
এমনকি নুসরাত প্রিন্সিপাল সিরাজের বিচার দাবিতে গভর্নিং বডির সভাপতি ফেনীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি কে এম এনামুল করিমের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তখন নুসরাত ও তার মাকে তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষের কক্ষে যখন গেছ তখন হজম করতে পারলে না কেন।’
পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির কাছে নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন।
সেখানে তিনি বলেন, ৪ এপ্রিল সকালের নুসরাত ও ছেলে নোমানকে নিয়ে মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তারা অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চান তাকে।
এর উত্তরে গভর্নিং বডির সভাপতি বলেছিলেন, ‘মামলা তো করে ফেলেছেন। মামলা করার আগে এলে দেখতাম কী করা যায়।’ তাঁর এমন বক্তব্যে ওই সময় বিস্ময় প্রকাশ করে নুসরাতের পরিবার।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি ফেনীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (রাজস্ব) পি কে এনামুল করিম প্রথম দিকে বলেছিলেন, তাঁর এই বিষয়টি দেখার সময়ই হয়নি এবং মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজ এতো খারাপ লোক এই বিষয়টিও না কী তিনি জানতেন না! হায় সেলুকাস! প্রশ্ন উঠেছে, কমিটির অন্য সদস্যরাও কেন ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সেই সময়েই ব্যর্থ হয়েছেন?
একই সূত্র জানায়, গত ২৭ মার্চ কুখ্যাত প্রিন্সিপাল সিরাজের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার পর, এমনকি তাকে গ্রেফতারের পরও তাকে মাদ্রাসা থেকে বহিস্কার করা হয়নি। উল্টো প্রিন্সিপাল মুক্তি পরিষদের ২০ সদস্যকে নেপথ্যে থেকে নানাভাবে ইন্ধন দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে তোলপাড় করার পর গভর্নিং বডির টনক নড়ে। মাদ্রাসা থেকে তখন সিরাজকে সাসপেন্ড করা হয়! অবশেষে বাতিল হয় গভর্নিং বডি।
এর আগে গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায় জামায়াত নেতা প্রিন্সিপাল সিরাজের ‘পোষ্য খুনিরা’। এরপর টানা চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে হেরে যান নুসরাত।
সূত্র মতে, কাল বিলম্ব না করে দেশ-বিদেশে আলোচিত এ মামলাটি তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।
এই কমিটির প্রধান করা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম রুহুল আমিনকে। ইতোমধ্যেই সেখানে অবস্থান করে তাঁরা পুরো বিষয়টি তদন্ত করেছে। এরপর তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ প্রধানের কাছে জমা দেওয়া হবে।
গত শুক্রবার (১২ এপ্রিল) পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার) রাজধানীর মিরপুরে শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা ওসিকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি।
এখন তদন্ত চলমান রয়েছে। যদি তাঁর কার্যকলাপে প্রমাণ হয় যে মামলাটি যথাযথভাবে সামাল দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাঁর (ওসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ফেনী জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার তিনদিন পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার প্রাথমিক তদন্তের বিষয়গুলো উল্লেখ করে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) একটি প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল নুসরাত হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশের ‘অ্যাকশন’ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি কোন পুলিশ সদস্যের গাফিলতি থাকলে তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন।
শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরায় তৈরি পোশাক মালিক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নবনির্মিত কমপ্লেক্সে শিল্প পুলিশ বিভাগকে ৫টি পিকআপ ভ্যান হস্তান্তর অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেছেন, পুলিশের সহায়তায় দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা অগ্নি-সন্ত্রাসের সময় ভালো অবস্থানে ছিলো।
পুলিশের সহযোগিতায় নুসরাত হত্যায় সব আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ বিজ্ঞপ্তি আকারে তা প্রকাশ করবে। তাছাড়া এ হত্যার পেছনে কারা জড়িত, কখন, কিভাবে হত্যা করেছে সব প্রকাশ করা হবে।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বিশ্বনেতা শেখ হাসিনাও নুসরাত হত্যাকান্ডের বিষয়ে হার্ডলাইনে ছিলেন এবং আছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদ করে নুসরাত এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি নুসরাতের মা-বাবা-ভাইকে গণভবনে ডেকে আন্তরিক সমবেদনা জানান এবং তাদের সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সম্ভাবনাময়ী নুসরাতকে মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক এক পরিণতি বরণ করে অনন্তলোকে যাত্রা করতে হয়েছে। তাঁর বিদায়ে দেশ, সমাজ ও সভ্যতা সম্মুখীন হয়েছে কোটি প্রশ্নের।
নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও ধর্মীয় কঠোর অনুশীলনের পাদপীঠ মাদ্রাসার নিরাপদ চৌহদ্দি কেন মৃত্যুকূপে পরিণত হলো এই প্রশ্নও বড় দাগে উঠে এসেছে। আবার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, এক ওসি’র দায়িত্ব অবহেলা, গাফিলতি ও বিতর্কিত ভূমিকায় গোটা পুলিশ বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও সুযোগ নেই।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে- প্রখর খরতাপে ধূলা ওড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ববোধ, জীবনবাজি রেখে কোনো পুলিশ সদস্যের অপরাধী ধরার কৃতিত্ব বা জীবন দিয়ে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস রুখে দেওয়ার মতো ঘটনায় নিজেদের দেশপ্রেমের বার্তা বার বার দিয়েছে পুলিশ।
ভুলে গেলে চলবে না, জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ বিশ্বের রোল মডেল। দেশের জঙ্গিবাদ বিরোধী অপারেশনগুলো কিভাবে সফল হয়েছে, তা এখন বিভিন্ন দেশের পুলিশ একাডেমি, পুলিশের ইনস্টিটিশনগুলোতে পড়ানো হচ্ছে। গোটা বিশ্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুলিশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি।
কালের আলো/এএ