সংসদে চেনা স্টাইলে রওশন, মুখর ৮ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে

প্রকাশিতঃ 10:46 pm | May 01, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

সামাজিক নানা অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকন্ঠ। বৈশ্বিক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিবাদী মুখ। শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থীর লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা এবং মাদ্রাসার নিরাপদ চৌহুদ্দিতে নুসরাত হত্যাকান্ড গভীর এক ক্ষত তৈরি করে তাঁর হৃদয়ে।

খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োগের ফলে ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকি’র পাশাপাশি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়েও সচেতনতা গড়তে সরব রয়েছেন দীর্ঘদিন। আবার শিক্ষার্থীদের আকাঙ্খাকে ধারণ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নুন্যতম ৩২ করার দাবিও উচ্চারণ করেছেন একাধিকবার।

জনস্বার্থেই যেন ‘বিবেকের জাগ্রত কন্ঠস্বর’ হয়ে উঠেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ এমপি। মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সংসদে সমাপনী বক্তব্যেও নিজের চেনা স্টাইলে আরো একবার একই ভূমিকায় দেখা গেলো সাবেক এই বিরোধী দলীয় নেতাকে।

নিজের সমাপনী বক্তৃতায় নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়ায় স্বাগত জানানোর পাশাপাশি নিউজিল্যান্ডের মসজিদে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর শ্রীলংকায় গির্জা ও আবাসিক হোটেলে ভয়াবহ বোমা হামলায় নারকীয় হত্যাকান্ড, ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যাকান্ড, নারী নির্যাতন-সবই উঠে আসে।

বাদ যায়নি আসন্ন রমজানে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা, খাদ্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, রাজধানীর বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত, শেয়ারবাজার ধস, বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ, চাকরিতে বয়সসীমাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ই।

ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ এসব বার্তার মাধ্যমে প্রকারান্তরে প্রশংসিত হয়েছেন বিরোধী দলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ এমপি। সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি তাঁর প্রাণবন্ত বক্তব্য শেষদিনে রীতিমতো জমিয়ে দেয় সমাপনী অধিবেশন।

রাজকীয় দালানের বাসিন্দা থেকে শুরু করে পাড়ার টং দোকানের লোকজন যারাই শুনেছেন সবাই একবাক্যেই যেন রওশনের স্বভাবসুলভ বক্তব্যে আশান্বিত হয়েছেন।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) রাত থেকে বুধবার (০১ মে) সকাল পর্যন্ত কালের আলোকে ফোন করে অনেকেই বলছেন, রওশন এরশাদের আগে যিনি বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন তিনি সংসদ বর্জনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। জনস্বার্থের বিষয়গুলোর বদলে তাঁর বক্তব্যে প্রাধান্য পেতো উস্কানী, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার মোহের বিষয়টি।

এক্ষেত্রে প্রথম ব্যতিক্রম ধারার সূচনা করেছেন রওশন। দশম জাতীয় সংসদে কঠিন সঙ্কটময় মুহুর্তে বিরোধী দলীয় নেতার পদ গ্রহণ করে নিজে যেমন সরকারকে ভালো কাজে সাধুবাদ জানিয়েছেন তেমনি ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ করেছেন। দেশের একমাত্র বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে নিজে সংসদ বর্জন করেননি, দলকেও করতে দেননি। রেখেছেন সরকারকে সহযোগিতার দৃষ্টান্তও।

সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবেই একাদশ জাতীয় সংসদেও দেশবাসীর মন জয় করারও পদক্ষেপ গ্রহণ করে শক্ত হাতে সংসদে ‘দলের হাল’ ধরেছেন জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে ‘সেকেন্ড ম্যান’ হিসেবে পরিচিত এ সংসদ উপনেতা।

দশম সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবেও ২৪২ কার্য দিবস উপস্থিত থেকেও ইতিবাচক রাজনীতির উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন বেগম রওশন এরশাদ। ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের এ সংসদ সদস্যকে ভাবা হয় স্বামী এরশাদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে ‘ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে।

দশম সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও রওশন এরশাদের ধীর-স্থির মনোভাব এবং নীতিতে অটল থাকায় তাকে পছন্দ ও বিশ্বাস করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।

সমাপনী বক্তৃতায় কী বললেন রওশন?
বিএনপিকে জাতীয় সংসদে স্বাগত জানান সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ। তিনি সম্প্রতি শ্রীলংকায় ঘটে যাওয়া সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত হয়েছি। সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

শোকপ্রস্তাব আনা হয়েছে। আমরা এ ঘটনায় ধিক্কার জানাই। নিউজিল্যান্ডেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সারাবিশ্বে সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেই চলেছে। এটা বন্ধ হচ্ছে না।

ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। নুসরাতের ঘটনা দেখেছি। শিক্ষার্থীরা আজ শিক্ষকের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে। শিক্ষকের হাতেই যদি ছেলেমেয়েরা নিরাপদ না থাকে, তাহলে তারা লেখাপড়া কার কাছে শিখবে?

সহিংসতার বিষয়ে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রওশন বলেন, সামাজিক অবক্ষয় যেভাবে বেড়ে চলেছে, তা দুঃখজনক। সবমিলিয়ে সামাজিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করছে। ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে সমাজের চরম অবক্ষয়।

সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনার বিচার করা সম্ভব হলে নির্যাতনের ঘটনা কমবে বলে মনে করি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিতে পারেন, সংযোজন করে বলেন এরশাদ পত্নী।

বিরোধী দলীয় এ উপনেতা বলেন, সামনে রমজান মাস। এসময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। অন্য দেশে রমজান মাসের দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে দেয়, আর আমাদের দেশে হয় উল্টোটা। প্রতিবছরই এটা হয়ে থাকে।

তিনি বলেন, রমজান মাসে প্রতিটি জায়গায় ছোট ছোট আকারে ইফতারি বিক্রি করে। অস্বাস্থ্য পরিবেশে তা বিক্রি করা হয়। এসব খাবার পরীক্ষা করা হয় না। এভাবে ইফতারি বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে, যেন মানুষকে অখ্যাদ্য না খেতে হয়। এসময় তিনি সবার জন্য সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান।

সংসদে দেওয়া বক্তব্যে বিরোধী দলীয় উপনেতা বহুতল ভবনগুলোতে আগুন নেভানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সততার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। সিলেট-হবিগঞ্জের মতো জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রবণতা বেশি হওয়ার এর পেছনের কারণ অনুসন্ধানেরও তাগিদ দেন।

পাশাপাশি শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে তো শুরু থেকে ধস নেমে এসেছে। এখন আগের যুগের মতো মাটির ব্যাংকে টাকা রাখতে হবে বলে মনে করছি। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার যেন ভালোভাবে চলে, সেদিকে নজর দিতে হবে। শেয়ারবাজারে ছোট ছোট বিনিয়োগকারীরা ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে সাবেক এ বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, জঙ্গিবাদ এখন সারাবিশ্বে একটি বড় সমস্যা। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, আমাদের দেশে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তখন জাতির পিতাকে হামলা করে হত্যা করা হয়েছিল। তখন থেকে আমরা জঙ্গি হামলার সম্মুখীন হচ্ছি।

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের এ সংসদ সদস্য বলেন, চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ না করে যদি ৩২ করা হয়, তাহলে ভালো হয়। প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো একজন মা। আপনি চিন্তাভাবনা করে তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এসময় তিনি রাত ১২টার পর ফেসবুক বন্ধ রাখার পক্ষেও মত দেন।

কালের আলো/এএ/এমকে