১২০ দিনে কী ‘অর্জন’ প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি’র?

প্রকাশিতঃ 8:25 am | May 09, 2019

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :

সবাই মিলে ‘টিম’ হিসেবেই কাজ শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। সচিবালয়ে প্রথমবারের মতো শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে বসে ঘোষণা দিয়েছিলেন-শিক্ষায় সরকারের সাফল্যকেই সুসংহত করতে চান। শুরুতেই প্রয়াস নিয়েছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারীতে ‘বিধ্বস্ত’ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঘুরে দাঁড়ানোর।

দেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস সংস্কৃতিকে ‘হিমঘরে’ পাঠিয়েছেন। নিজের বদলে অবিশ্বাস্য এ ‘কৃতিত্ব’ দিয়েছেন সবাইকে। টানা ৫ দিন এমপিওভুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন আন্দোলন শুরু করেছিলেন শিক্ষকরা।

আরো পড়ুন: আলোকময় উজ্জ্বল ভবিষ্যত উপহারে শিক্ষার মানোন্নয়নে নজর শিক্ষামন্ত্রী’র

ওইবারই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কোন মন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষকদের আশ্বাস দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে আন্দোলন স্থগিত করাতে সক্ষম হন। তাদের কাছ থেকে শিক্ষামন্ত্রী সময় নিয়েছিলেন দেড়মাস। পরে মন্ত্রী মাসখানেকের মধ্যেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা দিয়ে কথা আর কাজের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে দেখান।

শিক্ষামন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে চার মাস পূর্ণ হয়েছে ডা: দীপু মনির। প্রথম চার মাসে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া এ মন্ত্রী মেডিকেল কলেজের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা জরুরি বলেও মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের কথা বলেছেন।

মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষাখাত পরিচালনায় শিক্ষা প্রশাসন আরো কার্যকর করা, কোচিং বাণিজ্যের দৌরাত্ম বন্ধ ও যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়নের জন্য কাজ করতে। দীর্ঘদিন আটকে থাকা শিক্ষা আইন পাসের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করার বিষয়েও জোর দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও মেধা মননের বিকাশে উদ্ধুদ্ধ করছেন।

আরো পড়ুন: প্রশ্নফাঁস ঠেকিয়ে ‘পরীক্ষায় উত্তীর্ণ’ শিক্ষামন্ত্রী!

সকালের সূর্যই নাকি বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে? তেমনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে ডা: দীপু মনি’র প্রথম ১২০ দিনের কার্যক্রম থেকেই স্পষ্ট হয়েছে মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন অভিজ্ঞ এ মন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও সফলতার সঙ্গেই সামলেছেন। সরকারের তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাঁর ১২০ দিন পূর্ণ হয়েছে বুধবার (০৮ মে)।

আর এ সময়ে মন্ত্রণালয়ে কাজের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি নানা কর্মকান্ডে মুন্সীয়ানা ও মন্ত্রণালয়ের ইমেজ ফিরিয়ে আনতেও প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন মেঘনাপাড়ের এ কন্যা।

পর্যবেক্ষক মহলের ভাষ্য হচ্ছে, বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক ও মন্ত্রী হিসেবেও পরিচিত ডা: দীপু মনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে সমুদ্রজয়ে প্রশংসার আলোরেখা ছিলো তাঁর মুখে। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও মন জুড়ানো হাসি মুখায়বে। এ উজ্জ্বল হাসির দ্যুতিই বলে দেয় স্বল্প সময়েই শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাঁর অর্জন নেহায়েত কম নয়।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন মাল্লা নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার চমকের মন্ত্রীসভায় অভিজ্ঞ মন্ত্রী হিসেবে শুরুতেই প্রশংসিত হয়েছেন দীপু মনি। প্রতিহিংসার রাজনীতি যেমন বিশ্বাস করেন না তেমনি বাক সংযমেও অতুলনীয়। শুধুমাত্র কাজ দিয়েই নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিতে চান।

প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ও বিশ্বাস থেকে দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে চান। শিক্ষার দুর্বলতা ও অসঙ্গতি দূর করার পাশাপাশি সংবেদনশীলতা ও সচেতনতা নিয়ে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন নিজের শিক্ষক ও শিক্ষা পরিবারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

বিনয়, মার্জিত রুচি, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের অধিকারী ডা: দীপু মনির বাবা ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। আপোসহীন এ রাজনীতিক ১৯৪৯ সালে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু’র সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।

সেই পরিবার থেকে উঠে আসা দীপু মনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও আলো ছড়িয়েছেন। বাবা’র পথ অনুসরণ করেই বঙ্গবন্ধু কন্যা’র বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত হিসেবেই নিজের অনন্য এক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন চাঁদপুরের চাঁদমুখ।

চলতি বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে জাতীয় প্রেসক্লাবে আন্দোলনরত শিক্ষকদের দূয়ারে গিয়ে মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি নিজেও শিক্ষকের সন্তান। আমার মা দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করেছেন।

আমরা জানি কোন পেশার মানুষ কেমন আছে। যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি তাদের সমস্যা সম্পর্কেও অবগত আছি। আশা করছি এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে আমরা ঘোষণা দিতে পারবো।’

এরপর মন্ত্রী ঘোষণা দেন, এক মাসের মধ্যেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার। সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়নি।

তবে এবার এমপিওভুক্তির জন্য চারটি সূচকের ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে থেকে আবেদন নেওয়ার পর সেখান থেকে মন্ত্রণালয় যোগ্য প্রতিষ্ঠান ঠিক করার কাজ শুরু করে। মন্ত্রী ওই সময় জানান, চারটি প্রধান শর্তের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে তারা যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাছাই করে রেখেছেন।

যারা এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না তাদেরও নিরাশ করেননি মন্ত্রী। বলেছেন, ‘যারা যোগ্য হতে পারেননি, তারাও যেন যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সেজন্য তাদের উৎসাহিত করা হবে।’

প্রশ্নফাঁসের মতো গলার কাঁটা বন্ধ করে মন্ত্রী সরকারের শিক্ষাখাতে অর্জনকে আবারো দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে সব মহলেই প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি মেডিকেল কলেজের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা’র বিষয়টিও ভেবে দেখছেন। হয়রানি, অর্থ অপচয় ও কষ্ট কমাতেই এদিকটায় নজর দিয়েছেন মন্ত্রী।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যা কিছু ভালো এ দুইয়ের মিলনে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকারও করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেছেন, যে পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে যথার্থ ভুমিকা রাখে, সে রকম পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেবে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। তিনি বলেন, যান্ত্রিক ও প্রাণহীন শিক্ষার বদলে আনন্দময় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতেও উৎসাহ দিচ্ছেন মন্ত্রী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের তিনি বলেছেন, লেখাপড়া শেষে চাকরি খুঁজলে হবে না, উদ্যোক্তা হতে হবে। শিক্ষার্থীরা অন্যের জন্য কাজ তৈরি করে দেবে।

মন্ত্রী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে বলেছেন শিক্ষার্থীদের। বিষয়টি অনুধাবন করেই ডা: দীপু মনি’র ভাষ্য হচ্ছে এমন- শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি সমালোচনামূলক যুক্তি ও বিশ্লেষণী সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

আমাদের ছেলেরা সঠিকভাবে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না। অনেক সময় বাংলায়ও তারা ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। ফলে তাদের চাকরি পেতে সমস্যা হয়।

এ সমস্যা থেকে উত্তরণে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পৃথিবী দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যুগের প্রয়োজন ও নিয়োগকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েট তৈরির সামর্থ্য অর্জন করতে হবে।

কালের আলো/এএএমকে