‘ব্যর্থ’ শোভন-রাব্বানী, পদবঞ্চিত নারী নেত্রীদের ওপর ‘মধ্যযুগীয়’ হামলার নেপথ্যে কী?

প্রকাশিতঃ 3:40 am | May 14, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

সম্মেলনের ১০ মাস পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর চরম বিতর্কের মুখে পড়েছেন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। পদবঞ্চিতদের বিক্ষোভ ঠেকাতে গিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিজ সংগঠনের নারী নেত্রীদের ওপর তাদের ‘গুণধর’ শিষ্যরা হামলা চালিয়েছে।

এ ঘটনায় দেশজুড়েই চরম সমালোচনা হচ্ছে ছাত্রলীগের বর্তমান দুই কান্ডারীকে নিয়ে। মূলত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান না পাওয়া এবং উপযুক্ত পদে মূল্যায়ন না হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কমিটির বিরোধীতাকারীদের ‘শায়েস্তা’ করতেই নারকীয় স্টাইলে এমন হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’।

আরো পড়ুন: ছাত্রলীগের হামলার নেতৃত্বে ৫ নেতা, নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে শ্রাবণী শায়লাকে!

দলটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে ভীষণ অসন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেক স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পালাবদল হলেও সম্মেলনের ৯ মাস পরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরিচয় দেন শোভন ও রাব্বানী। ফলে ছাত্রলীগের আগাম সম্মেলনেরও গুঞ্জণ শুরু হয় দলীয় পরিমন্ডলে। অবশেষে নানা নাটকীয়তার পর সোমবার (১৩ মে) রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানী’র স্বাক্ষরে ৩০১ সদস্য ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।

সূত্র মতে, এ কমিটি ঘোষণার পর পরই এ কমিটিকে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করে সোমবার (১৩ মে) সন্ধ্যায় মাঠে নামেন পদবঞ্চিত ও ত্যাগ থাকা সত্ত্বেও অমূল্যায়িত নেতা-কর্মীরা। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনের সামনে গেলে তাদের ওপর হামলা চালায় শোভন-রাব্বানীর শিষ্যরা, এমন অভিযোগ শুরু থেকেই উচ্চারিত হয় বিক্ষোভকারীদের মুখে।

আরো পড়ুন: শেখ হাসিনার সাক্ষাত চান আহত ছাত্রলীগ নেতা-নেত্রীরা

জানা যায়, ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের নতুন কমিটির বিরুদ্ধে ওই বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন ছাত্রলীগের বিদায়ী কমিটির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার শাহজাদা, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপসম্পাদক রাকিব হোসেন, জসিম উদ্দিন হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান, রোকেয়া হলের সভাপতি বি এম লিপি আক্তার, বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের সভাপতি ফরিদা পারভীন, সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা, শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের সভাপতি নিপু তন্বী, সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য জারিন দিয়া প্রমুখ।

হামলায় আহত হয়েছেন যারা
বিক্ষোভকারী নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর থেকে মধুর ক্যান্টিনের সামনে এগুতেই নতুন কমিটিতে শোভন-রাব্বানীর অনুসারী পদধারীরা তাদের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় হামলা করে।

এতে রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী দিশা, রোকেয়া হল শাখার সভাপতি ও ডাকসুর ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক বি এম লিপি আখতার, সুফিয়া কামাল হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিলোত্তমা শিকদারসহ কয়েকজন মারাত্মক আহত হন।

আরো পড়ুন: বিবাহিত সোহানী তিথি ও আঞ্জুমান অনু কীভাবে ছাত্রলীগের কমিটিতে?

এর মধ্যে গ্লাস ছুঁড়ে শ্রাবণী দিশার চোখে মারা হয়েছে। এতে তাঁর চোখের কর্ণিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাথার পেছনে আঘাত পেয়েছেন ডাকসু’র ক্রীড়া সম্পাদক তানভীর শাকিল।

রোকেয়া হলের সভাপতি লিপি আক্তার লিপি আক্তার, ডাকসু’র সদস্য ও বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের সভাপতি ফরিদা পারভীন, কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপ-সম্পাদক ও ডাকসু’র সদস্য তিলোত্তমা শিকদার, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য জেরিন দিয়া ও বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন।

আহত হয়েছেন রোকেয়া হলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী ইসলামও। তিনিও চোখে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য জেরিন দিয়া কালের আলোকে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সংবাদ সম্মেলন করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ঠিক ওই সময়েই আমাদের ওপর নারকীয় হামলার ঘটনা ঘটে।

আরো পড়ুন: শোভন-রাব্বানীর ‘গোমর ফাঁস’করলেন ছাত্রলীগ নেত্রী জেরিন দিয়া

তিনি বলেন, নতুন কমিটিতে ত্যাগীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। যারা দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন তাদের মূল্যায়ন না করে নব্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে।

হামলার শিকার রোকেয়া হলের সভাপতি বি এম লিপি আক্তার কালের আলোকে অভিযোগ করে বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমরা আন্দোলন করছিলাম। কিন্তু আমাদের গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে। এটার প্রতিবাদ করায় তাঁরা আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। আমাদের ওপর নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপসম্পাদক পদ পাওয়া তিলোত্তমা শিকদার নিজেরসহ অন্যদের অবমূল্যায়নের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। হামলার শিকার হতে হয়েছে তাকেও। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের এমন কোনো কর্মসূচি ছিল না যেখানে আমি উপস্থিত হইনি। অথচ আমাকে উপসম্পাদক করা হয়েছে। এটি আমাদের মতো ত্যাগীদের জন্য অপমানের।’

আরো পড়ুন: হামলায় আহতদের পাশে ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জিত, বিচার চান হামলাকারীদের

শোভন-রাব্বানীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
এ হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে শোভন-রাব্বানীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্ধারিত সময়ে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে না পারাসহ নানান ঘটনায় এমনিতেই তাঁরা চরম বিতর্কে জড়িয়েছেন। এরই মধ্যে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হামলার ঘটনাও তাদের নেতৃত্বের অযোগ্যতারই বহি:প্রকাশ বলেও মনে করছেন সংগঠনটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।

এমনকি নেতিবাচক এ ঘটনার পরও তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। এখন পর্যন্ত তাঁরা নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেননি গণমাধ্যমের সামনে। কালের আলো’র পক্ষ থেকেও একাধিকবার এ হামলার বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।

কালের আলো/এমআর/এএ