২৮ বছর পর খুলছে ডাকসু’র বন্ধ দরজা

প্রকাশিতঃ 12:29 pm | March 02, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো :

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানের কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী এক বছর পর বেশ ঘটা করেই অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন। ইতোমধ্যে নির্বাচনের একটি ডেটলাইনও প্রস্তুত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। সেই প্রস্তুতি নিয়েই এগুচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে উপাচার্য অধ্যাপক ডা: আখতারুজ্জামানের বার্তা পৌঁছে গেছে সংশ্লিষ্টদের কাছে। চলছে ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজও। দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরির এ ‘আতুড়ঘর’র বন্ধ দরজা খুলার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে বেশিরভাগ ছাত্রসংগঠন।

জানা যায়, ‘বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ছাত্রদের অধিকার আদায় ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্ল্যাটফর্মও ধরা হতো এ ছাত্র সংসদকে।

কিন্তু দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হয় না। জাতির ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি করতেই অবশেষে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর মাধ্যমে ছাত্র সমাজের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে নব-নির্বাচিত রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি অধ্যাপক ডা:এম.এ.আজিজ দৈনিক কালের আলোকে বলেন, ‘আদর্শিক, সৃজনশীল, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব তৈরি করতে ডাকসু নির্বাচনের বিকল্প নেই। এ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়াই ছিল আমাদের (সিনেট সদস্য) অন্যতম প্রধান কাজ। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করেও এ নিয়ে কথা বলেছি। ২০১৯ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করেছে।’

তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে না। ঐতিহাসিক বাস্তবতাতেই ডাকসু হলো এ দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সূতিকাগার। রাজনীতির ডাকসাইটে নেতাদের অনেকেরই হাতেখড়ি হয়েছে ডাকসু থেকে।
এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরই দাবি ছিল না, দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সকলেই দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নির্ধারিত সময়েই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ২৮ বছরের প্রতীক্ষারও অবসান ঘটবে।’

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডাকসু। ১৯৫৩ সালের আগ পর্যন্ত ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) মনোনয়ন করা হতো। ওই বছরই প্রথম নির্বাচন হয়। ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৭ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশে ২০ ধারা অনুযায়ী, সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকার কথা, যাঁরা ডাকসুর মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসবেন। কিন্তু দিনের পর দিন নির্বাচন না হওয়ায় খণ্ডিত সিনেট নিয়েই সভা বসছে।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের সময় প্রায় নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শুরুতেই ১৯৭২-৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। এরপর বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯-৮০ ও ৮০-৮১ সালে, আবদুস সাত্তার সরকারের আমলে ১৯৮২-৮৩ এবং এরশাদের আমলে ১৯৮৯-৯০ ও ১৯৯০-৯১ ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর আর কোন নির্বাচন হয়নি। ফলে এ নির্বাচনের জন্য ২৮ বছর যাবত ক্লান্তিহীন অপেক্ষা করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সবাই।

গত বছরের ৪ মার্চ ডাকসু নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বারোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’

এর আগে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী। গত বছরের ৮ এপ্রিল হাইকোর্ট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ১৭ জানুয়ারি ৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে দেয় হাইকোর্ট। মূলত রাষ্ট্রপতির আগ্রহ ও হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রেক্ষিতেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জোর প্রস্তুতি শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ২০১৯ সালের মার্চ মাসকে টার্গেট করা হয়েছে। আগামী বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষে আমরা কিছু কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছি। সে অনুযায়ীই কাজ চলছে।’

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ডাকসুর ভিপি (১৯৭২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এর বাস্তবায়ন চাই।’

ডাকসুর সাবেক জিএস মোশতাক হোসেন (১৯৮৯-৯০) বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান সময়ের দাবি ছিল। হাইকোর্টেরও কঠোর নির্দেশনা ছিল। রাষ্ট্রপতি নিজেও এ নির্বাচনের গুরুত্বারোপ করেছেন। অবশেষে বিলম্বে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে।’

 

কালের আলো/আরএম/এএ