মুক্তিযুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর আন্ত-অভিযানের সূচনার ইতিকথা জানালেন সেনাপ্রধান

প্রকাশিতঃ 8:02 pm | May 24, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত মহান মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছরের শোষণ-বঞ্চনার শাপমুক্ত হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল এ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই। পাকিদের কব্জা থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে রণাঙ্গণে লড়াইয়ে নেমেছিলো দামাল ছেলেরা। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সেনাবাহিনীর সদস্যরাও।

আরো পড়ুন: হাওয়াইতে সিম্পোজিয়ামে সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন কালের আলোতে

মূলত ওই সময়ই গড়ে উঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাই দেশপ্রেমিক এ বাহিনীটিকে বলা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। ইতিহাসের মহীয়ান অধ্যায় ও মুক্তিকামী বাংলার মানুষের বীরত্বগাঁথার বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের আত্নপ্রকাশের আগে হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজের জবাব দিতে সেই সময়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আন্ত:অভিযানের সূচনা হয় ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।

মঙ্গলবার (২১ মে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের রাজধানী হুনুলুলুতে ‘ল্যান্ড ফোর্সেস অফ দ্যা প্যাসিফিক সিম্পাজিয়াম এবং এক্সপজিশন (লেনপেক) এ নিজের বক্তব্যের শুরুতেই মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর আন্ত-অভিযানের সূচনার ইতিকথার বিষয়টি উপস্থাপন করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

আরো পড়ুন: সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিকেই শান্তি অভিযানে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করেন সেনাপ্রধান

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আন্ত-অভিযানের সূচনার বিষয়টি গর্বের সঙ্গেই তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়।

সেই সময় আমাদের সেনাবাহিনী ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অংশ হিসেবে যুদ্ধ করেছিল। এভাবে আমাদের যোদ্ধাদের আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর আন্ত-অভিযান সক্ষমতা বিকশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ একটি অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত লোকজনের মধ্যে পরিচালিত দীর্ঘ ও সফল দমন অভিযান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পরিপক্ব করেছে।

আরো পড়ুন: শান্তিরক্ষা মিশনে সাফল্য-অন্তরায়ের কারণ বললেন সেনাপ্রধান

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ৩১ বছরের বেশি সময় ধরে অবদান রাখার বিষয়টি তুলে ধরে সেনাপ্রধান বলেন, বাংলাদেশের সমাজে বিদ্যমান উৎকৃষ্ট রীতিনীতি এবং কার্যকর ও গতিশীল প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সেনাবাহিনীর অভিযোজন-ক্ষমতা আরও ত্বরান্বিত করেছে।

এসব যোগ্যতা শান্তি বিনির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আগমনকে সহজ করেছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে একটি নেতৃস্থানীয় সৈন্য অবদানকারী দেশ হয়ে ওঠার পথ তৈরি করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন দেশে কয়েকটি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছি।

আরো পড়ুন: বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের কর্মতৎপরতা লাল-সবুজের পতাকার সুনামের স্মারক, বললেন সেনাপ্রধান

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ ও অবদানের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। সেই ভূমিকাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে সিম্পোজিয়ামে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত তুলে ধরেন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।

সেখানে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও একজন সেনাপ্রধান হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে শান্তিরক্ষা মিশনে সাফল্য এবং সমস্যার চূলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনকে কীভাবে আরো কার্যকর, ফলপ্রসু ও অর্থবহ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ব্যাপারে নিজের অভিমত তুলে ধরে হয়েছেন প্রশংসিত।

সিম্পোজিয়ামে সেনাপ্রধান বলেন, মিশন এলাকার সামগ্রিক কর্মক্ষম পরিবেশের উপবিভাগ হিসেবে সামাজিক নির্মাণ সর্বদাই সুষ্ঠু কাজের অন্তর্নিহিত সমস্যা হয়ে রয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও সামাজিক অনুশীলনের প্রতি নিয়োজিত বাহিনীর বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি আন্ত-অভিযান সক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ব্যবধান আন্ত-অভিযান সক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে।

আরো পড়ুন: বিশ্বমঞ্চে শান্তিরক্ষায় নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শুনালেন সেনাপ্রধান

ব্লু হেলমেটে যুক্ত হওয়ার এক দশক পর থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষস্থানীয় সৈন্য অবদানকারী দেশ হয়ে ওঠে জানিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিত বাহিনীটির এ প্রধান বলেন, ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ডে’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইরাকে বড় বহুজাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তখন থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন’-এ অংশ নিয়ে এ অঞ্চলে তার উপস্থিতি বজায় রেখেছে।

এ পর্যন্ত ২২ হাজার ২২২ জন বাংলাদেশি সেনা এ অভিযানে অংশ নিয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থার অধীনে এই অভিযান নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে আন্ত-অভিযান দক্ষতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক সমঝোতা স্মারকের অধীনে আমরা সৌদি আরবের দক্ষিণ প্রদেশগুলোতে দুটি মাইন অপসারণকারী প্রকৌশলী ব্যাটালিয়ন পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।

আরো পড়ুন: ঐকতানেই মিশনের সাফল্য, দ্বন্দ্বে বিঘ্ন, বলছেন সেনাপ্রধান

তিনি বলেন, এই অংশগ্রহণ, সংহতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে আন্ত-অভিযান সক্ষমতার মান আরও বাড়বে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য ইউরোপ এবং আমেরিকায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। অদ্যাবধি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪০ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ৪০টি দেশের ৫৪টি শান্তিরক্ষা অভিযানে অংশ নিয়েছে।

জাতিসংঘ এখন বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টের কাছে বিপজ্জনক পরিবেশে অভিযানের গুরুদায়িত্ব দিতে প্রস্তুত, যেখানে আরও বেশি আন্ত-অভিযান সক্ষমতা প্রয়োজন। কঙ্গোতে বাংলাদেশি বাহিনী বিভিন্ন দেশের মিত্র ও সহযোগী বাহিনীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় মাত্রার আন্ত-অভিযান সক্ষমতার মাধ্যমে সুচারুভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দক্ষিণ সুদান, মালি ও মধ্য আফ্রিকার চলমান শান্তি অভিযানেও অংশ নিচ্ছে, যেখানকার অভিযানের পরিবেশে আন্ত-অভিযান সক্ষমতা অত্যাবশ্যক, যোগ করেন বঙ্গবন্ধুর চেতনার এ স্বপ্ন সারথী।

কালের আলো/এএ/এএএএমকে