ভোট দিবেন কিসে- নৌকা না ধানের শীষে?

প্রকাশিতঃ 11:45 am | April 02, 2018

:: শেখ আদনান ফাহাদ ::

বছরখানেক আগে এক বিকালে শাহবাগের আজিজ মার্কেটের কাবাব ধাবায় এক ছাত্রদল নেতার সঙ্গে দেখা। হলের বড় ভাই, কলেজেরও বড় ভাই। তিনি ছিলেন ক্যাম্পাসে বাস্তবের সালমান খান। অমন হ্যানসাম, ড্যাশিং মানুষ জীবনে খুব কম দেখেছি। গোপালগঞ্জের ছেলে, করতেন ছাত্রদল। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে খালি হাসতেন। ছাত্ররাজনীতি না করে যদি মডেলিং, অভিনয় করতেন তাহলে আজ তিনি অন্যতম বড় তারকা হয়ে থাকতেন, এ বিশ্বাস আমার সব সময়ই ছিল। কিন্তু সেদিন দেখে বিশ্বাস হলো না। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছেন। সঙ্গে মোটরসাইকেল আছে বটে। কিন্তু চেহারায়, পোশাকে ও দেহভঙ্গিতে সেই তেজের লেশমাত্র নেই। বললাম, ‘ভাই, এ অবস্থা কেন?’ বিব্রত হলেন তিনি। দলে কী অবস্থা, জানতে চাইলে খুব বিমর্ষ বদনে জানালেন ছাত্রদলের সেন্ট্রাল কমিটির এখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট। এখনো!!

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর যাদের তিনি হলে তুলেছেন, তাদেরই অনেকে এখন ছাত্রদলের ভাইস প্রেসিডেন্ট, জয়েন্ট সেক্রেটারিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে আছেন। উনিও ভাইস প্রেসিডেন্ট আর ওনার চেয়ে ৭/৮ বছরের জুনিয়র ছেলেরাও ভাইস প্রেসিডেন্ট! সাত-আট বছর অনেক লম্বা সময়। এ সময়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, ভালো রেজাল্ট করে ভালো চাকরি পেয়ে বিয়ে-শাদি করে সংসার গুছিয়ে ফেলে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, বিয়ে করেছেন?’ মুখ নেড়ে ‘না’ বললেন। কাবাব ধাবার ‘গরুর চাপ’ খেতে খেতে কথা বলছিলাম দুজন। ভাই আমাকে বিল দিতে দিলেন না। আমি খুব চাপাচাপি করলাম। উনি আমাকে ধমক মেরে বললেন, ‘তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, না? ফাজিল। আমার কাছে এখন টাকা আছে, তুই কেন দিবি?’ বিল দিয়ে ভাই মোটরসাইকেলে করে চলে গেলেন। আমি হাঁটতে থাকলাম।

ঢাকার ফুটপাতে ভাবতে ভাবতে আস্তে হাঁটা যায় না। পরিবাগ ব্রিজ পার হয়ে টংদোকান পেয়ে বসলাম। ‘সময়’ নিয়ে একটু ভাবলাম। ছাত্রদলের বন্ধুদের সঙ্গেও আমার দেখা হয় মাঝে মাঝে। ৩৫-৩৬ বছর বয়স আমাদের। ছাত্রলীগের বন্ধুদের প্রায় সবাই এখন বাবা, বড় চাকরি করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, রাজনীতিও চালিয়ে যাচ্ছেন সিনিয়র নানা সংগঠনে। আমার বয়সী কেন? জুনিয়র অনেককেই দেখলাম, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে অবসরে চলে গেছে। এখন বড় চাকরি করে, অথবা নিজের ব্যবসা আছে। একসময় ছাত্ররাজনীতি করা ছেলে ঠিকমতো বিয়ে করবে, এ কথা অনেকেই বিশ্বাস করতেন না। এখন ছাত্ররাজনীতি করা ছেলেরা শুধু বিয়ে করে, তা না, বিবাহবার্ষিকীর তারিখটা পর্যন্ত মনে রাখে। সময় করে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে সাগরপাড়ে ঘুরতেও যায়। সন্তানকে কোলে নিয়ে গর্বিত বাবা হিসেবে ফেসবুকে ছবি দেয়।

বাংলাদেশের দুই প্রধান দলের ছাত্রসংগঠনের এমন ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা কেন? ছাত্রদল হয়তো বলবে, ক্ষমতায় থাকলে তাদেরও এমন গোছানো সংসার থাকত। আসলে বিষয়টা কি শুধুই ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত? বিএনপিও অনেক লম্বা সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির আমলের কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতাদের দেখলে ঠিক ছাত্রনেতা মনে হতো না। তখনই তাদের অনেকের বয়স ছিল ৪০-৪৫। সময়ের রাশ অনেকটাই টেনে ধরেছে ছাত্রলীগ। ছাত্রদল সেটা পারেনি। ছাত্রসংগঠন হিসেবে অনেক এগিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। অছাত্র, বিবাহিতরা এখন এখানে ‘নট অ্যালাউড’। কিছু কিছু মফস্বল ইউনিটে কখনো ‘আদু ভাই’দের দেখা মিললেও ছেঁটে ফেলা হচ্ছে।

এই কৃতিত্ব কি ছাত্রলীগের নিজের? নাকি সিনিয়র নেতৃত্বের। আমার ধারণা, ক্রেডিট গোস টু মেইন পার্টি লিডারশিপ। ‘লিডারশিপ’-এর প্রশ্নে পিছিয়ে পড়েছে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো। ২০১৯ সালের নির্বাচন এগিয়ে এসেছে। বাকি মাত্র এক বছর। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক উভয় উপায়ে শত চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে পারেনি বিএনপি ও তার রাজনৈতিক সাথী জামাত। এর মধ্যে আবার ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে খালেদা জিয়া ‘সহিংস’ পথ ছেড়ে ‘শান্তি আর বুদ্ধিমত্তা’র পথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

যদিও এখন পর্যন্ত এই ভিশন-২০৩০ দিয়ে মাঠে-ময়দানে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি বিএনপি। দেশের মানুষ তেমন একটা চমকিত হয়নি বলেই ধারণা আমার। আওয়ামী লীগ যেমন ২০০৮ সালে ভিশন-২০২১ ঘোষণা দিয়ে, ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা দিয়ে জনগণের বিশেষ করে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর হৃদয় কেড়েছিল, বিএনপি সেটা পারেনি। আমার মনে হয়, জেলে থাকতেই শেখ হাসিনা ভেবে রেখেছিলেন, মুক্ত হয়ে দেশের জন্য, দলের জন্য কী কী করবেন? খালেদা জিয়াও জেলখানায় ছিলেন, কিন্তু শেখ হাসিনার মতো হয়তো কিছু ভেবে রাখেননি। জেল থেকে বের হয়ে শেখ হাসিনা শুধু দল গোছানোর কাজেই হাত দেননি, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জেতাতে পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। যেসব জায়গায় যেতে পারেননি সেখানে তিনি টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেছেন নেতা-কর্মী, সাধারণ মানুষের সঙ্গে। শেখ হাসিনা, দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে জনতার মাঝে পরিবর্তনের আওয়াজ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।

দেশের ইতিহাসে অন্যতম সুষ্ঠু সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। স্বার্থান্বেষীরা আওয়ামী লীগের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভয় পেয়ে শুরুতেই ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত ভয়াবহ অরাজকতা ঘটায়। সে ধাক্কা সামলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার সামনের দিকে যাত্রা শুরু করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজে বেশ ভালো অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। গোলাম আযম, নিজামি, মুজাহিদ, দেলোয়ার সাঈদীদের এ দেশে বিচার হবে, এ আশাতে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল তরুণ সমাজ। শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ ভালোই এগিয়েছে। শুধু সাঈদীর ফাঁসি না হওয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছিল, সে ধারণারও বাস্তবায়ন করে চলেছে দলটি।

অনেক ক্ষেত্রে নানা সরকারি-বেসরকারি সেবায় পরিবর্তন এসেছে। যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দেন, তারা বুঝতেই পারবেন না যে আমাদের এনালগ আমলে প্রক্রিয়া কেমন ছিল। বিসিএসের ফর্ম সংগ্রহ ও জমা দিতে প্রার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আর এখন, নীলক্ষেতে এক কাপ চা শেষ করা যায় না, বিসিএসের ফর্ম ফিল-আপ শেষ হয়ে যায়।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতখানি শক্তিশালী হয়েছে, তার শুধু দুটি উদাহরণ দিব। মিয়ানমার আর ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াই করে বিশাল সমুদ্রসীমা বিজয় আর পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংককে সফলভাবে মোকাবেলা করে বাংলাদেশ তার শক্তিমত্তার প্রমাণ রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ জয়লাভ করে বাংলাদেশ আসলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেই একহাত নিয়েছে। বামেরা ‘বিপ্লব’ ‘বিপ্লব’ বলে গলা ফাটালেও আসল বিপ্লব করেছে আওয়ামী লীগ। নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক ইস্যুতে জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংককে দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী সরকার তথা বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিল। পশ্চিমা আতঙ্কে ভয় না পেয়ে শেখ হাসিনা সরকার নিজের ওপর জনগণের ওপর ভরসা রেখে কাজ করে গেছেন। কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, বিশ্বব্যাংক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার করেছিল। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বব্যাংক ইস্যুতে শুধু আওয়ামী লীগ একা জয়ী হয়েছে তা নয়, পুরো বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। বস্তুত, বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সহযোগী ছিল সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে মার্কিন ব্লকের কারসাজি ছিল বলে শেখ হাসিনা তাঁর অনেক বক্তব্যে বলেছেন। যাই হোক. দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ব্লক বাংলাদেশে কোণঠাসা অবস্থায় আছে। এটি অবশ্যই আওয়ামী লীগের বড় অর্জন।

খাদ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গত আট বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অসামান্য অর্জন লাভ করেছে। সর্বশেষ হাওর অঞ্চলে ভারত থেকে আসা বানের পানিতে মানুষের ফসল ভেসে গেলেও সরকার একটা মানুষকেও না খেয়ে কষ্ট করতে দেয়নি। উত্তরবঙ্গ থেকে মঙ্গা বিদায় করেছে বহু আগেই। বিশ্বব্যাংকেরই একটা প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, আওয়ামী লীগের ৮ বছরে দারিদ্র্য কমেছে ১২ শতাংশ। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে বহু আগে। রাশিয়ার সহযোগিতায় রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে অভাবনীয় পরিবর্তন আসবে পুরো বাংলাদেশে। কষ্ট আর অরাজকতার শহর ঢাকায় অনেক পরিবর্তন আসছে। ফ্লাইওভারগুলো সব নির্মিত হলে আশা করি পরিবর্তন আসবে। মেট্রোরেল চালু হলে নিচের রাস্তার যানজট খুব একটা না কমলেও ওপর দিয়ে রেলের যাত্রীরা খুব দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। ঢাকার সঙ্গে দেশের নানা জেলার রেলওয়ে নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হচ্ছে। লেন বাড়ছে সড়কে।

তবে গত ৯ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতার দিকও আছে। বড় তিনটি ইস্যু হচ্ছে ঢাকার সড়ক পরিবহন, এসএসসি, এইচএসসির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং কোটা সংস্কার-সংক্রান্ত বিতর্ক। সরকারের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো হাতেনাতে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রশাসন এ ব্যর্থতা স্বীকার করছেন না। কী কারণে উনারা ব্যর্থতা স্বীকার করছেন না সেটি আওয়ামের বোধগম্য হচ্ছে না। জনগণ সরকারের সাফল্যে উল্লসিত, উদ্দীপিত। পাশাপাশি এই তিনটি খাতে ব্যর্থতায় কষ্ট পাচ্ছে। ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে নতুন মানুষদের দায়িত্বে এনে দেখতে পারে সরকার। নতুন দায়িত্ব পেয়ে নতুন প্রশাসকরা যদি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন তাহলে বাজিমাত করবে সরকার, এ কথা বলা যায় নিশ্চিন্তে। তখন বিরোধীদের কথা বলার সুযোগ আরও কমে যাবে।

অতীতে নানা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের ‘অপপ্রচার’ সামাল দিতে পারেনি দলটি। বঙ্গবন্ধুর আমলেও বিরোধী পক্ষ অপপ্রচারকেই তাদের হাতিয়ার বানিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছিল। সে কাজে মদদ দিয়েছিল একশ্রেণির মিডিয়া। দেখা গেছে, প্রতিপক্ষরা সাধারণত ‘ধর্ম’কে বিরাট অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এখানেও আওয়ামী লীগকে এবার বেশ প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। সর্বশেষ মক্কা-মদিনার ইমাম সাহেবদের ঢাকায় এনে বিএনপি-জামাতের ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি করার পথও বন্ধ করে রেখেছে। অরাজনৈতিক ‘ইসলামি’ শক্তি হেফাজতে ইসলামের সঙ্গেও সরকার ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এতে ঢাকার কিছু বুদ্ধিজীবী ভয় পেয়ে বিবৃতি দিলেও প্রধানমন্ত্রী সব পরিষ্কার করেই তুলে ধরছেন। কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি দিয়ে সরকার অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানেও ঢাকা-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে সরকার। কোথাও পরিবর্তন আনতে হলে, তার কাছে গিয়েই আনতে হয়। ইসলাম ধর্মকে অবজ্ঞা করে এদেশে কেউ রাজনীতি করে সফল হবে না। ইসলাম ধর্মের মর্মার্থ না বুঝে রাজনীতি করলে, মাদ্রাসা কমিউনিটির কাছে না গেলে, এই স্পর্শকাতর ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নেবে জামাত। তখন বড় কোনো বিপত্তি ঘটলে এই বুদ্ধিজীবীদের খোঁজে পাওয়া যাবে না। এভাবেই ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি করার পথও বন্ধ করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ।

পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, দেশীয় বিরোধী শক্তি ‘গণতন্ত্র’ ফেরানোর কথা বলে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিএনপি-জামাতের পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় নির্বাচনের বিতর্ক চাপা পড়ে যায়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন পায় সরকার। প্রশাসন নিবিড়ভাবে কাজ করে তখন হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসকে রুখে দেয়। সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করে ঘরের বাইরে এসেছে। ব্যবসায়ীরা পুলিশি প্রহরায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে গেছে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ স্বাভাবিক হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। খালেদা জিয়াও বুঝেছেন, সহিংস পথে ফায়দা করা যাবে না। তাই হয়তো ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছেন তিনি। কিন্তু বিএনপি নিজেই বলছে যে এটি নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়! সব মিলে একটা জগাখিচুড়িঅবস্থা তাদের।

২০১৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি কীভাবে আসবে সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। একদিকে নির্বাচনে আসতেই হবে বিএনপিকে, না এলে নিবন্ধন বাতিল করবে নির্বাচন কমিশন। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও বিতর্ক আছে। বিএনপি মাঝে মাঝে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেখ হাসিনা তখন প্রধানমন্ত্রী থাকলে তারা নির্বাচনে যাবে না। বিএনপি নির্বাচনে যদি না আসে তাহলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে বিএনপিরই। আবার বিএনপি নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে নিয়ে যেতে পারবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। একাধিক মামলায় বিচারের সম্মুখীন তিনি। ইতোমধ্যে তিনি কারাগারে গমন করেছেন।

সব মিলে আওয়ামী লীগ অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে দলটি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যেখানেই যাচ্ছেন, নৌকার জন্য ভোট চাচ্ছেন। ফেসবুক খুললেই দেখা যাচ্ছে, ‘নৌকায় ভোট দিন’ নামের একটি পেইজ। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রচার শুরু করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, ভিশন-২০৩০ তাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযান নয়! এখানেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির পার্থক্য। আওয়ামী লীগ এগিয়ে থেকেও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আর বিএনপি পিছিয়ে থেকেও অপ্রস্তুত।

এত উন্নয়ন কাজ করেও আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক ও নেতার ভেতরে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অনলাইনে সরকারের পক্ষে যায় কোনো লেখা প্রকাশিত হলে, মন্তব্যগুলো পড়লে মনে হয়, দেশের সরকারের বিরোধী মহল অনেক বেশি সোচ্চার। সরকারপন্থী লোকজনকে খুব বেশি সোশ্যাল মিডিয়াতে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। নানা ক্ষেত্রে হতাশা যেমন আছে, পাশাপাশি আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক নজির সৃষ্টি করেছে সরকার। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে স্থায়ীভাবে নাম কাটানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘ। সে মাহেন্দ্রক্ষণ জাতিকে এনে দেয়ার সুযোগ কি এই সরকার পাবে? ভোট দিবে যে জনগণ! তাই জনগণের কাছে প্রশ্ন, আপনার ভোট আপনি দিবেন, যাকে খুশি তাকে দিবেন? নাকি যে আসল হকদার, তাকে দিবেন?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়