একজন আলোর দিশারী ‘খোকন স্যার’
প্রকাশিতঃ 6:58 pm | October 05, 2019
কালের আলো ডেস্ক:
সদা হাস্যোজ্জ্বল, ঈর্ষণীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে সচেতন, একান্তভাবেই অমায়িক, স্বীয় নীতিতে আস্থাশীল এবং ধীরচিন্তার অধিকারী একজন মানুষ। শুধু বিভাগেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থীদের তিনি একজন প্রিয় ও আদর্শ শিক্ষক। নিজের জীবনাদর্শ থেকে সরেননি কখনো, স্বার্থের জন্য করেননি এতটুকুও অবস্থান বদল! নীরবে-নিভৃতে নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন।
তিনি সবার প্রিয় খোকন স্যার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ। খোকন স্যার হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত তিনি।
বর্তমানে জামালপুরে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেফমুবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য; যিনি দেশ-বিদেশে অর্জিত নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিকমানের গবেষণানির্ভর ‘মডেল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ গড়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৮ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই নেমে পড়েন শূন্যে থাকা একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আকৃতি দেওয়ার কাজে। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনায় এরই মধ্যে জোরেশোরে শিক্ষা কার্যক্রমও শুরু করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা। শিক্ষার পাশাপাশি একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের যা যা করণীয় তা শেখাতেও সব উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
আন্তঃবিভাগ খেলাধুলার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জনকল্যাণে নিবেদিত মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজেও সম্পৃক্ত করছেন তিনি। শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রিয় এবং আদর্শ শিক্ষকের জায়গাটি দখল করে নিয়েছেন মানুষ গড়ার কারিগর প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র মোহাম্মদ হাছান বলেন, সবার জীবনেই কিছু কিছু মানুষের ভূমিকা এমন যে, সেটা কখনোই অস্বীকার করা তো দূরের কথা, ভুলে যাওয়াও যেন দুষ্কর। শিক্ষার্থীদের বেলায় তা আরও বাস্তব! কারণ একজন আদর্শ শিক্ষককে ‘নায়ক’ হিসেবে দেখে দেখেই নিজেদের ভবিষ্যতের কর্ণধার হিসেবে গড়ে তোলে তারা। সেক্ষেত্রে আমাদের নায়ক সবার প্রিয় শিক্ষক ও আদর্শ প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ। আমরা তাকে ভিসি স্যার বলেই ডাকি।
‘স্যারের সঙ্গে সেভাবে আমাদের সরাসরি দেখা কম হয়। তবে শূন্যে থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেভাবে তিনি নিজ সন্তানের মতো তিলে তিলে গড়ে তুলছেন, যেভাবে আমাদের আগলে রেখেছেন, তা আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্ধুদ্ধ করে। আমাদের কখনোই মনে হয় না যে আমরা নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
একজন আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ তা-ই। তিনি একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। নিজের ব্যক্তিজীবন থেকেও শিক্ষার্থীদের কথা আগে ভাবেন, নিজে জ্বলতে থাকা সলতে হয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের মাঝে।
তার পূর্ব কর্মস্থল রাবি ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, সবার প্রিয় খোকন, স্যার। অনেকের অনেক দিক থাকতে পারে। কিন্তু খোকন স্যারের দিক একটাই, সেটা হলো শিক্ষার্থীদের কথা ভাবা। একজন ভালো শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়লে তার অন্যদিকে না তাকিয়ে তিনি তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।
রাবিতে তার সহকর্মী মহিউদ্দিন মোল্লা বলেন, ভূ-তত্ত্ব আর খনিজ সম্পদের উন্নয়ন নিয়ে তার গবেষণা রয়েছে। কিন্তু সব বিষয়েই তার অগাধ প্রজ্ঞা। রবীন্দ্রনাথের বহু কিছু তার যেমন মুখস্থ, অনর্গল বলতে পারেন। তেমনি জানেন শেক্সপিয়রও। নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে শুরু করে নির্মলেন্দু গুণের কবিতাও পড়েন অবসরে।
ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন। চাইলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে ধারণ করে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। নিজ গবেষণা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন দেশকে। তার প্রায় ৫২টি গবেষণাপত্র দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
জনপ্রিয়তম এই মানুষটি রক্ত-শ্রম-ঘামে গড়ে তুলছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বয়সে এসে নিজের কথা না ভেবে, নিজের স্ত্রী-সন্তানের কথা না ভেবে, কাজ যে করা যায়, এমন একজন মানুষের নামও ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল কলেজের অধ্যক্ষ তার একজন ছাত্র। শিক্ষাগুরু সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, রাবিতে আমি খুবই কম সময় ছিলাম। সেখানে পড়া অবস্থায় সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। তবে ওই সময়েই আমি দেখেছি-নিজের ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত করতে স্যার কেমন অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও সংগ্রাম চালিয়ে যান। আজ তার শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, ভালো জায়গায় ভালো অবস্থানে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। সাদামাটা পোশাক আর সহজ চালচলনে অভ্যস্ত হলেও মাটির এই মানুষটির পর্বতসম ব্যক্তিত্ব প্রথম বর্ষেই নবীন শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে। আর তা থেকে যায় আজীবন। নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর সততার গুণে নিজেকে আজ এক উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছেন স্যার।
ড. সামসুদ্দিনের জন্ম রাজশাহীতে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা, সবেই পদ্মাপাড়ের নান্দনিক এই শহরেই। দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ মতিহারের সবুজ ক্যাম্পাস রাবির ভূ-ত্তত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৭৯ সালে স্নাতক ও ১৯৮২-তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ড. সামসুদ্দিন।
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই নিজের মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ। পড়াশোনা ও নিয়মতান্ত্রিক চলাফেরার মাধ্যমে সহপাঠী ও শিক্ষকদের প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।
শুরু হয় ঈর্ষণীয় ভবিষ্যত নির্মাণের পথে তার বিস্ময়কর যাত্রা। তীব্র প্রতিযোগিতায় রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তরে প্রথম বিভাগে প্রথম হন তিনি।
এরপর ১৯৮৩ সালে নিজ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। শুরু হয় তার কর্মজীবনের নতুন পথচলা। ১৯৯৩ সালে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
এরপর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমদ প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত নিজ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও হলের। ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত রাবির মাদার বখশ হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি লিমিটেডের বোর্ড পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৭ বছর। রাবি প্রেসের প্রশাসক ছাড়াও দায়িত্ব পালন করেছেন রাবি সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে।
রাবির বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অফিসার কল্যাণ পরিষদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ।
এখনও দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ড. সামসুদ্দিন। তিনি ভারতের নয়াদিল্লির জাতীয় পরিবেশবিদ্যা একাডেমির আজীবন সদস্য।
জামালপুরের মানুষ বলছেন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে তার মতো নীতিবান ও পরিশ্রমী এবং স্বনামধন্য শিক্ষাবিদকে পাওয়াটা গর্বের। স্থানীয় তরুণ মো. শহীদুজ্জামান বলেন, আমরা আশা করি তার হাত ধরেই নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার দেশসেরা এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
প্রফেসর ড. সামসুদ্দিন স্যার, একজন স্বপ্নবান মানুষ। নতুন নতুন ধারণা নিয়েই নিরন্তর ছুটে চলেন তিনি। আলোকিত-বিকশিত মানুষ তৈরির ব্রত নিয়ে তরুণ শিক্ষক হিসেবে যিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন মতিহারের সবুজ ক্যাম্পাসে, চিরতরুণ এই অধ্যাপক আজ অবহেলিত জামালপুরেও নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার আলো জ্বালানোর ব্রত নিয়ে কাজ করে চলেছেন। আলোর দিশারী সবার প্রিয় খোকন স্যার এই কাজেও সফল হবেন বলেই প্রত্যাশা তার অনুরাগীদের।
৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস, শিক্ষক দিবসে মানুষ গড়ার কারিগর মহান এই শিক্ষকের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
কালের আলো/বিআর/এমএম