ম্যানহোলের ঢাকনা চোর থেকে শত কোটি টাকার মালিক ‘পাগলা মিজান’

প্রকাশিতঃ 3:58 pm | October 08, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

পুরো নাম মিজানুর রহমান। শুরুতে মিরপুরে হোটেল বয়ের কাজ করতেন। ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি ও ছিনতাইও ছিল তাঁর পেশা। কয়েক দশক আগে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পুকুরে নেমে ‘দিগম্বর’ হয়েই না কী উঠে এসেছিলেন! ‘পাগল’ হিসেবে সেদিন পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই থেকেই ‘পাগলা মিজান’ হিসেবেই পরিচিতি পান। এরপর উত্থান ভয়ঙ্কর-বিস্ময়কর। তাকাতে হয়নি পেছন ফিরে।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাকারীর ভাই কীভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন?

এখন তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। সময়ের ধারাবাহিকতায় নাম পাল্টেছেন। হয়েছেন হাবিবুর রহমান মিজান। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে এহেন কোন অপরাধ নেই যা তাঁর অভিধানে নেই। মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা, ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলার শীর্ষ আসামি তিনি। ফ্রিডম পার্টির কর্মী হিসেবে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক পথচলা। বেড়ে উঠেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে।

প্রায় ৩০ বছর আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দলবলে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে সফল হতে পারেননি বহু অপকর্মের হোতা মিজানের ছোট ভাই ফ্রিডমের পার্টির মোহম্মদপুর-ধানমন্ডি থানার সমন্বয়ক মোস্তফিজুর রহমান মোস্তফা।

আরও পড়ুন: হলো না শেষ রক্ষা, যেভাবে ধরা পড়লো ‘পাগলা মিজান’

ছোট ভাইকে এ ঘটনায় নানাভাবে সহায়তা করলেও পরবর্তীতে ভোল পাল্টাতেও সময় নেননি মিজান। জার্সি বদল করে ফ্রিডম পার্টির নেতা থেকে ভিড়ে যান আওয়ামী লীগে! রাতারাতি ভাগিয়ে নেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। দলটির কেন্দ্রীয় এক নেতার ‘মাইম্যান’ হয়ে দলে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন।

ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন গোটা এলাকায়। মূলত ওই নেতার ‘আশীর্বাদ’ পেয়েই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও খুন-খারাবির মাধ্যমে অসীম ‘ক্ষমতাধর’ হয়ে উঠেন এই ‘পাগলা মিজান।’ মোহাম্মদপুর এলাকার কিলার গ্রুপের মূলহোতাও এ সুযোগ সন্ধানী।

আরও পড়ুন: পাগলা মিজানের বাসায় র‌্যাব, মিলেছে ৮ কোটি টাকার চেক

পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গেও রয়েছে তাঁর গভীর সখ্যতা। অভিযোগ রয়েছে, এ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নানা অপকর্মে সহায়তা করেন ঢাকা মহানগর মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ে মুখ খোলার সাহস করেন না কেউই। সমঝে চলতে হয় সবাইকে। সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার কথা জানতেন সেই ‘পাগলা মিজান’!

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার চলমান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও একাধিক হত্যা মামলার এ আসামির ‘টিকিটি’ স্পর্শ করা যায়নি। এতোকিছুর পরেও তিনি কীভাবে প্রকাশ্যে বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এ নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন: কার ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ ছিলেন পাগলা মিজান, ‘লাপাত্তা’ আদাবরের তুহিন!

জানা যায়, ঝালকাঠির ছেলে মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান। ঢাকায় আসেন ১৯৭৪ সালে। ওই সময় রাজধানীর মিরপুরে হোটেল বয় হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে পেশা বদল করেন। শুরু করেন মোহাম্মদপুর এলাকার ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির কারবার।

কথিত আছে, চুরি করা সেই ঢাকনাই তিনি বিক্রি করতেন সিটি করপোরেশনে। এ কারবার করতে করতেই ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে খামারবাড়ি খেজুরবাগান এলাকায় ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের ধাওয়ার মুখে পড়েন।

ওই সময় নিজেকে বাঁচাতে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশের পুকুরে নেমে পড়েন। পুলিশ বার বার তাকে পুকুর থেকে উঠে আসার আহ্বান জানালেও কর্ণপাত করেননি। এর কয়েক ঘন্টার মাথায় পুরোপুরি ‘দিগম্বর’ হয়ে পুকুর থেকে টানে উঠে আসেন। পাগলের কৌশল নিয়ে পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেলেও নাম হয়ে উঠে ‘পাগলা মিজান।’ সেই থেকেই গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নামডাক। ছিচকে চোর থেকে হয়ে উঠেন শীর্ষ সন্ত্রাসী।

খোঁজ খবর নিয়ে আরো জানা যায়, ‘পাগলা মিজান’ হয়ে উঠার পরপরই ফ্রিডম পার্টির রাজনীতিতে নাম লেখান। ওই দলটির সদস্য হিসেবেই গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে লিবিয়ায় যান। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগ নেত্রী রেজিয়া বেগমের খাবার লাথি মেরে ফেলে দিয়ে প্রথমবার আলোচনায় আসেন।

সূত্র জানায়, শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাকারীদের অন্যতম ছিলেন মিজানুর রহমান মিজানের সহোদর ছোট ভাই ফ্রিডমের পার্টির মোহম্মদপুর-ধানমন্ডি থানার সমন্বয়ক মোস্তফিজুর রহমান মোস্তফা। পরবর্তীতে নিজেদের কোন্দলে তিনি মারা যান।

মূলত ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা সেখানে গুলি করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।

এ সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাড়ির ভিতর অবস্থান করছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। নিজের ‘গুণধর’ ছোট ভাইয়ের এসব অপকর্মে সরাসরি শেল্টার দিতেন মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান এমন অভিযোগও রয়েছে।

সূত্র মতে, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ওই টার্গেট কিলিংয়ের অপচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন সেই মিজানের ছোট ভাই মোস্তফিজুর রহমান মোস্তফা। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। ধানমন্ডি থানায় মামলা নম্বর-২৪, তারিখ- ১১/০৮/৮৯।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদ ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা এবং নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগপত্রে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা হামলার পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী দলের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

একই সূত্র জানায়, শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া এবং এরপর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে মিজানুর রহমান নিজের নাম পাল্টে হয়ে যান হাবিবুর রহমান মিজান। যে নেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হামলা করেছিলেন তাঁর ছোট ভাই, দলটির গুটিকয়েক নেতার শেল্টারে সেই দলেই ভিড়ে যান মিজান। ভাগিয়ে নেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ।

দলটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার ফ্রিডম মোস্তফার সহোদর বড় ভাই মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজানদের জন্য দলের দু:সময়ের নিবেদিতপ্রাণ নেতারা এখন রাজনীতিতে কোণঠাসা। কয়েকবার জেলে গেছেন। ইয়াবা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতার সময়ে টেন্ডারবাজির মাধ্যমেই প্রায় ৫’শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এসব নেতা-কর্মীরা বলছেন, বরাবরই মিজানকে ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন দলটির প্রভাবশালী এক নেতা। ক্ষমতাসীন দলের অন্য নেতাদের সঙ্গেও রয়েছে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। ফলে নানা অপকর্ম করেও বারবার বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসতে আবারো মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের প্রশ্ন, তবে এবারও কী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মূল কুশীলবের ভাই তাঁরই দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসবেন?

এসব অভিযোগের বিষয়ে মিজানুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান ওরফে হাবিবুর রহমান মিজানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে বহুবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

কালের আলো/এডিভি/এমএএএমকে