শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাকারীর ভাই কীভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন?
প্রকাশিতঃ 11:29 am | October 11, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :
ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার মিজানুর রহমানকে সবাই চেনেন ‘পাগলা মিজান’ নামে। হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির বিস্তর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। এবার না কী তাঁর নজর পড়েছে খ্রিষ্টানদের জায়গাতেও! ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরের শাসনামলে তাঁর শনৈ শনৈ উন্নতি। তাঁর বিস্ময় জাগানিয়া উত্থানে হতবাক রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দারাও।
আরও পড়ুন: ম্যানহোলের ঢাকনা চোর থেকে শত কোটি টাকার মালিক ‘পাগলা মিজান’
খোদ এ এলাকাতেই রয়েছে তাঁর বাণিজ্যিক ভবন, অনেক বাড়ি-ফ্ল্যাট। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে তাঁর একাধিক বাড়ি। চড়েন দামি গাড়িতে। রাজসিক জীবন যাপনে হয়ে পড়েছেন অভ্যস্ত। মোহাম্মদপুর এলাকায় রয়েছে তাঁর বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী।
এলাকা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির জন্যও রয়েছে তাঁর আলাদা বাহিনী। জমি দখল থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের মাদক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে পিলে চমকানো এসব তথ্য।
আরও পড়ুন: হলো না শেষ রক্ষা, যেভাবে ধরা পড়লো ‘পাগলা মিজান’
সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরুর পর এমন সব অপকর্মের ফলে নানা মহল থেকে তাকে গ্রেফতারের দাবি তুঙ্গে উঠেছে। কিন্তু এ ‘ফ্রিডম গুরু’ এবং তাঁর বাহিনীর কাউকেই এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অনেকেই বলছেন, ‘ক্যাসিনো গডফাদার’ ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সরকার।
ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার থেকে ডিগবাজি খেয়ে নামধারী আওয়ামী লীগ নেতা বনে যাওয়া হাবিবুর রহমান মিজানদের মতো আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকদের গ্রেফতার করতে পারলে বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তায় আরো একধাপ এগিয়ে যাবেন বলে মনে করছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার সচেতন নাগরিকরা।
আরও পড়ুন: পাগলা মিজানের বাসায় র্যাব, মিলেছে ৮ কোটি টাকার চেক

জানা যায়, ঝালকাঠি থেকে ১৯৭৪ সালে ঢাকায় আসা এক সময়কার হোটেল বয় মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান নানা অবৈধ কর্মকান্ডের মাধ্যমে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালে চাঞ্চল্যকর ইউনুস হত্যা ও ২০১৬ সালে সাভারে জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার কথা জানতেন সেই ‘পাগলা মিজান’!
নিরীহ মানুষের জায়গা জমি দখল করে অনেকবার গ্রেফতার হয়েছেন। আবার অদৃশ্য খুঁটির জোরে বেরিয়ে এসে ফ্রিস্টাইলেই অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন মিজানুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বছিলা রোডে হাবিব প্লাজার মালিক তিনি। এর ঠিক পেছনেই খ্রিষ্টানদের জায়গা দখল করে নিয়েছেন। একই এলাকার ৭/৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে আওরঙ্গজেব রোডে রয়েছে চার তলা বাড়ি।
জাকির হোসেন রোডের ইম্পেরিয়াল গার্ডেন স্বপ্নপুরিতে ২৪/এ তে ০৫ টি ফ্ল্যাট, ২৪/সি এবং ২৪/ডি তে ০৩ টি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও গড়েছেন ‘সেকেন্ড হোম।’ সেখানে রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। একই রকমের বাড়ি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও।
অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, সিলিকন ভ্যালী হাউজিংয়েও জমি দখল করেছেন তিনি।

সূত্র মতে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে হত্যাচেষ্টাকারীদের অন্যতম ছিলেন মিজানুর রহমান মিজানের সহোদর ছোট ভাই ফ্রিডমের পার্টির মোহম্মদপুর-ধানমন্ডি থানার সমন্বয়ক মোস্তফিজুর রহমান মোস্তফা।
ওই সময় ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সশস্ত্র দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা সেখানে গুলি করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
এ সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাড়ির ভেতরে অবস্থান করছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় ছোট ভাই ফ্রিডম মোস্তফাকে পুরোদমে শেল্টার দিতেন এ মিজান।
কিন্তু এরপর রাতারাতি তিনি কীভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান করলেন এবং মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলেন এ নিয়েও ক্ষোভের অন্ত নেই দলটির নেতা-কর্মীদের মাঝেই।
মোহাম্মদপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা ওরফে ফ্রিডম মোস্তফা ১৯৯৫ সালে দুস্কৃতিকারীদের গুলিতে মারা যান। আর এক ভাই রাজিব ছিনতাই মামলায় আটক হয়ে ঢাকা কেন্দীয় কারাগারে মাদকাসক্ত হয়ে কারাগারেই মারা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে ফ্রিডম পার্টির পক্ষ থেকে মিজান, শামীম জালালী ওরফে দারোগার ছেলে শামীম, বাবুল ওরফে পিচ্চি বাবুলসহ কয়েকজন গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে লিবিয়ায় যান।

সূত্র জানায়, জমি দখল, মাদক স্বর্গরাজ্য, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণে মিজানের রয়েছে বিশাল সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। গত সপ্তাহে জমি দখলকে কেন্দ্র করে একদল সন্ত্রাসী একটি রিয়েল এস্টেটের ৬
কর্মীকে গুলি এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়।
এ হত্যাকান্ডেও হাবিবুর রহমান মিজানের নাম উঠে এসেছে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর সংঘর্ষের নেপথ্যেও উঠে এসেছে পাগলা মিজানের নাম।
অভিযোগ আছে, মিজান ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে ক্যাম্প লাগোয়া কাঁচাবাজার ও মাছবাজারের তিন শতাধিক দোকানে অবৈধ সংযোগ দিয়ে মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় করতেন। এ কারণেই বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর বিরোধ তৈরি হয়।
তাঁর ক্যাডার বাহিনীর প্রধান আদাবর থানা যুবলীগের সভাপতি তুহিন। মূলত পাগলা মিজানের অপরাধ সাম্রাজ্যের এ সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

সূত্রমতে, চলমান এ অভিযানে চরম বেকায়দায় পড়েছেন হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। নিজেকে রক্ষায় প্রভাবশালীদের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে গত মঙ্গলবার রাতে আওরঙ্গজেব রোডে পাগলা মিজানের বিলাসবহুল ফ্লাটে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। কিন্তু এ অভিযানের আগেই চম্পট দেন মিজান। বিভিন্ন সূত্রের খবর আগের মতো পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় এখন দেশে ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন রাতারাতি ধনকুবের এই পাগলা মিজান।
তবে তিনি র্যাবের চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ভোরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় শ্রীমঙ্গল থেকে হাবিবুর রহমান মিজানকে আটক করেছে র্যাব।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান জানান, চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে শ্রীমঙ্গল থেকে আটক করা হয়েছে। তিনি সীমান্ত এলাকা হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
কালের আলো/এডিভি/এমএএএমকে