জাতীয় প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে: সেনাপ্রধান (ভিডিও)
প্রকাশিতঃ 3:38 pm | October 29, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
মাতৃভূমির অখন্ডতা রক্ষা তথা জাতীয় যে কোন প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
আরও পড়ুন: দেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে : সেনাপ্রধান (ভিডিও)
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলাসহ দেশের আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতেও মাতৃভূমির অখন্ডতা রক্ষা তথা জাতীয় যে কোন প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
মঙ্গলবার(২৯ অক্টোবর) ইঞ্জিনিয়ার সেন্টার এন্ড স্কুল অব মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং, কাদিরাবাদ সেনানিবাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর রেজিমেন্টাল কালার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, বর্তমানে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অভূতপুর্ব অবদান রাখছে এবং কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে। সদর দপ্তর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, ‘বর্ডার রোড প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নের কার্ষপ্রম পরিচালনা করে আসছে।
‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, জাতীয় প্রকল্পসহ জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ প্রকম্পসমুহে আজ সেনাবাহিনী তথা কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স প্রশংসনীয় অবদান রেখে চলেছে, যা সত্যিই আমাদের গর্বের বিষয়।’
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্মরণ
সেনাপ্রধান বক্তব্যের শুরুতেই স্মরণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানক। তিনি বলেন, তার নেতৃত্বে সুচিত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম যার বলিষ্ঠ আহ্বানে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য জনগনের সাথে একাত্ম হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পুথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পায়।
তিনি বলেন, আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদদের। আমি গভীর শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে স্মরণ করছি যাদের আত্মত্যাগে অর্জিত হয়েছে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা।
‘আরও স্মরণ করছি, বাংলাদেশ সশ্রস্ত্র বাহিনীর ১৫৩৩ জন শহীদ বীর সেনানীদেরকে, যারা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, যার মধ্যে ৮৮ জন ছিল কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর সদস্য। অত্যন্ত গর্বের সাথে এবং গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এই কোরের একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান, মুক্তিযুদ্ধে শাহাদৎ বরণকারী বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে।’
সেনাপ্রধান বলেন, আমি আরও স্মরণ করছি, জীতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে দেশের মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গকারী ১১৮ জন বীর শহীদদের, যার মধ্যে ০৪ জন ছিলেন স্যাপার্স এবং বিডিআর বিদ্রোহে আত্মদানকারী ৫৯ জন বীর সেনানীদের, যার মধ্যে স্যাপার্স পরিবারের সদস্য ছিলেন ০১ জন।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস দমন অভিযানে জীবন উৎসর্গ করা ১৭০ জন বীর শহীদদের আআর মাগফেরাত কামনা করেন তিনি।
রেজিমেন্টাল কালার প্রাপ্ত ইউনিটের সদস্যদের স্মরণ
সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, আজকের এই মহতী দিনে আমি সশ্রদ্ধচিত্তে আরও স্মরণ করছি রেজিমেন্টাল কালার প্রাপ্ত ইউনিটের সকল প্রাক্তন ও বর্তমান সদস্যদের, যাঁদের দুরদর্শিতা, নিরলস পরিশ্রম ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় রেজিমেন্টাল কালার গ্রহণকারী এই ইউনিটগুলো আজ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
তিনি বলেন, এছাড়াও অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন (ওকেপি)তে ১৪ জন, এসটিএমকে/মেহেনী প্রজেক্টে ০৩ জন এবং অপারেশন মরু প্রান্তরে ০১ জন স্যাপার্স সদস্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন ।
‘দেশ মাতৃকার জন্য শাহাদাৎ বরণকারী সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাদের পরিবারবর্গের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।’
বীরত্বগাঁথায় সমুজ্জল কোর অব ইঞ্জিনিয়াদের ইতিহাস
সেনাপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর ইতিহাস বীরত্বগাঁথায় সমুজ্জল। স্বাধীনতার পরে কতিপয় অফিসার এবং সৈনিক নিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাজীরের আত্মদানের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের যাত্রা শুরু হয়।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর সেনাবাহিনী কমান্ড কর্তৃক প্রদত্ত একটি সমনে স্যাপার্স কর্মকর্তারা ঢাকায় একত্রিত হন। স্বাধীন দেশে স্যাপার্সের কোন বিদ্যমান ইউনিট ছিল না, কোন সেন্টার বা রেকর্ড ছিল না। এ সকল প্রতিকুলতার মধ্যেই সর্বপ্রথম ১ ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন গঠন করা হয় যার সদর দপ্তর ছিলো ঢাকায়।’
রেজিমেন্টাল কালার প্রদান
জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমি সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর গত ১১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে ৯ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদানের মাধ্যমে কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর ইউনিটসমুহকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদানের প্রথা সুচিত করেছি। এরই ধারাবাহিকতায় আজ ৪টি ইউনিটকে রেজিমেন্টাল কালার প্রদান করা হলো।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই ধারাবাহিক ও প্রশংসনীয় সাফল্য প্রদর্শনের মাধ্যমে ১ ও ৮ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন এবং ৫ ও ৭ আরই ব্যাটালিয়ন রেজিমেন্টাল কালার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
যেভাবে পুর্ণাঙ্গ ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন
সেনাপ্রধান বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত ৫টি ইঞ্জিনিয়ার ফিল্ড কোম্পানী এর মধ্যে সৈয়দপুর সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত ২৫ ফিল্ড কোম্পানী অন্যতম। পরবর্তীতে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে ২৫ ফিল্ড কোম্পানীকে ঘিরে ৮ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন তথা “উত্তম অষ্টম” নামে একটি পুর্ণাঙ্গ ডিভিশন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান এই ব্যাটালিয়নের প্রতিষ্ঠাকালীন অধিনায়ক ছিলেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সেনাপ্রধান বলেন, সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মধ্যে রাজবাড়ী সেনানিবাসে অবকাঠামো উন্নয়ন ও নদী রক্ষা প্রকল্প এই ব্যটালিয়ানের সার্বিক তক্তাবধানে সম্পন্ন হয়েছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। বিমান বন্দরের রানওয়ে সংস্কার কাজ, ঠাকুরগাও এয়ারপোর্ট মেরামত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম কার্যক্রম পরিচালনা করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়াও ১ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন অপারেশন দাবানল, ডিএনডি বাধ মেরামত, গোমতী বাধ নির্মাণ, হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর বাধ এবং চাদপুর শহর রক্ষা বাধ নির্মাণ, পদাতিক ভারী অস্ত্র ফায়ারিং রেঞ্জ নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে।
রেজিমেন্টাল কালার প্রাপ্তি বিরল সম্মানের
সেনাপ্রধান বলেন, রেজিমেন্টাল কালার প্রাপ্তি যে কোন ইউনিটের জন্য একটি বিরল সম্মান এবং পবিত্র আমানত। আজ সেই রেজিমেন্টাল কালার এই ৪টি ইউনিটের হাতে তুলে দেয়া হলো। এই বিরল সম্মান ও গৌরব অর্জন করায় আমি এই ইউনিটসমুহকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন । কর্মদক্ষতা, কঠোর পরিশ্রম এবং কর্তব্যনিষ্ঠার স্বীকৃতি হিসেবে যে পতাকা আজ আপনারা অর্জন করলেন, আমি আশা করি তার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আপনারা সবসময় সচেষ্ট থাকবেন।
শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য
তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও শক্তিশীলী সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আপনারা নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন হযে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এর আলোকে সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো বিন্যাস ও পরিবর্তনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এসময় তিনি রেজিমেন্টাল কালার প্রদান উপলক্ষে সুশৃঙ্খল, মনোজ্ঞ এবং বণিল কুচকাওয়াজ উপহার দেওয়ায় জিওসি, আর্টডক ও জিওসি, ১১ পদাতিক ডিভিশন ও এরিয়া কমান্ডার বগুড়া, ই-ইন-সি, পাপা স্যাপার্স, রেজিমেন্টাল কালারপ্রাপ্ত ইউনিট, স্যাপার্স পরিবারের সদস্যসহ উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে সেনা বাহিনীর উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম বকুল, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি এ কে এম হাফিজ আক্তার বিপিএম বার, নাটোরের জেলা প্রশাসক মোহম্মদ শাহরিয়াজ, পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহাসহ অসামরিক ব্যক্তি এবং ইঞ্জিনিয়ার কোরের সামরিক ও অসামরিক সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এনআর/এমএইচএ