‘শত্রু’ থেকে ‘দুস্তি’, নামে হাজী কাজে ‘পাজী’ মোহাম্মদপুরের মনির

প্রকাশিতঃ 1:32 pm | October 30, 2019

কালের আলো রিপোর্ট :

একদা দু’জনের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। জমি দখল নিয়েই প্রকাশ্যে গুলি বিনিময়ও হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে মুহুমুর্হু সেই গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছিল মোহাম্মদপুর এলাকা। দু’পক্ষের ‘যুদ্ধাংদেহী’ মনোভাবের ভেতর শান্তির সুর তুললেন ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী।

ব্যাস, শত্রু থেকে দুস্তিতে রূপ নিল কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও হাজী মনিরুজ্জামান মনিরের সম্পর্ক।

এরপর সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানা জমি অহরহ জবরদখল করলেন মুখচেনা এ চক্র। মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকা জমি দখলে নজর দিয়ে আখেরে লাভবান হলেন। তুরাগ তীরের শত একর জলাভূমি নিশ্চিহ্ন করে ট্রাকে ট্রাকে বালু ফেলে ভরাট করলেন। দু’জনে মিলে মালিক বনে গেলেন প্রায় দেড় শতাধিক প্লটের।

শক্তিশালী ‘বন্ধন’ গড়ে ওঠার পর চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায় হাত পাঁকালেন। প্রকাশ্যে হামলা-সন্ত্রাস চালিয়ে আতঙ্কিত করে তুললেন স্থানীয় সাধারণ মানুষকে। কামাতে শুরু করলেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।

গোটা মোহাম্মদপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের পর কাউন্সিলর রাজীব র‌্যাবের হাতে ধরা পড়লে একে একে ফাঁস হতে থাকে নামধারী আওয়ামী লীগ নেতা হাজী মনিরের গোমর। রাজীবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই মনির স্থানীয় জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

জমি দখলে অতুলনীয় রাজীব-মনির চক্র
পাড়ার টং দোকানি থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অত:পর নামে-বেনামে অঢেল ভূসম্পদের মালিক হয়েছেন মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব। সামান্য রাজমিস্ত্রীর সন্তান থেকে তাঁর বিলাসী জীবন স্টাইল হার মানিয়েছেন রূপকথাকেও।

মোহাম্মদপুর এলাকায় নিজের শাসন শুরুর পর জমিদখলবাজি নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজী মনিরুজ্জামান মনির। প্রায় দুই বছর আগে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটিতে তাদের দু’পক্ষের মাঝে প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

এরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রভাবশালী এক নেতার মধ্যস্থতায় দু’জনের শত্রু শত্রু খেলা বন্ধ হয়ে পরম মিত্রতে রূপ নেয় সম্পর্ক।

স্থানীয় মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, অন্যের জমি জবরদখলে জুড়ি নেই রাজীব-মনির চক্রের। ভেজাল জমি পেলেই যেমন তাঁরা ঢুকে পড়েন তেমনি সরকারি খাল থেকে শুরু করে খাসজমি বাদ যায় না কোন কিছুই। ভূয়া দলিল তৈরি করে নিজেরা দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন।

জমি দখলবাজিতে নিজস্ব বাহিনী রয়েছে তাদের। আবার মাদক ব্যবসার মাধ্যমেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্রটিই।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে কাউন্সিলর রাজীব স্বীকার করেছেন, স্থানীয় সন্ত্রাসী মনিরুজ্জামান মনির ওরফে হাজী মনিরের সঙ্গে দুস্তি গড়ে উঠে তাঁর। তারা দু’জন একযোগে বেড়িবাঁধ এলাকায় জমি দখলে নামেন। এভাবেই তুরাগ নদের জমি দখল করে প্রায় দেড় শতাধিক প্লটের মালিক হয়েছেন রাজীবও মনির। একইভাবে বছিলাতে বুড়িগঙ্গার জমি জবর দখলও করেছে এ চক্রটি।

জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব আরও জানিয়েছেন, গত ৫ বছরে ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, একতা হাউজিং, রাজধানী হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, গ্রিন সিটিসহ ১০টি হাউজিং প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু প্লট দখল করেছেন তিনি। তাকে এ কাজে সব রকমের সহযোগিতা দিয়েছেন সন্ত্রাসী মনির।

যেভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন মনির
ভূমি জবরদখলে নাম করা হাজী মনিরুজ্জামান মনিরের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত মনির আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

শাসক দলের একটি থানার সহ-সভাপতির পদই তাকে ধনে-মানে-ক্ষমতায় পরিপূর্ণতা দিয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরে রকেট গতিতে ঘুরিয়েছেন নিজের ভাগ্যের চাকা।

ফুলে-ফেঁপে উঠেছে মনিরের সম্পদ। তাঁর বিশেষ বাহিনীর চাঁদাবাজি ও জুলুমের মাত্রা বাড়ছে দিন দিন। আদাবর-মোহাম্মদপুর এলাকায় আরেক আতঙ্ক হয়ে উঠা মনিরের রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট, বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা সবই রয়েছে বলেও কান পাতলেই অভিযোগ শোনা যায় আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়।

এতোদিন রাজীব-মনিরের সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস না করলেও রাজীব গ্রেফতারের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। ঢাকা উদ্যানের অন্তত শতাধিক ব্যক্তি নিজেদের ওপর মনির বাহিনীর নির্যাতনের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন।

ভুক্তভোগীরা কালের আলোকে জানান, ঢাকা উদ্যানের ডি ব্লকের সাড়ে ৬ কাঠার ৫৪ নম্বর প্লটটি মনিরুজ্জামান মনির দখল করে দু’তালা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এসব প্লট দখলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজীবের প্রকাশ্য সহযোগীতা ছিল। বছিলাতে বুড়িগঙ্গার জমির দখলের অভিযোগও রয়েছে এ চক্রের বিরুদ্ধে।

একাধিক প্লট, জমিজমা দখল করে শনৈ:শনৈ: উন্নতি ঘটানো মনির রাজীব গ্রেফতারের পর চরম বিপাকে পড়েছেন। তবে রাজীব বাহিনীর ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে পরিচিত শাহ আলম জীবন, এ চক্রের সদস্য সিএনজি কামাল, অভি ফারুকসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছেন।

এ চক্রটিকে এখনই থামানো সম্ভব না হলে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি আর দখলবাজিতে আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন বলেই মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।

জলজ্যান্ত ত্রাস এরপরেও ধরাছোঁয়ার বাইরে
নদীর তীর ভরাট, চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্যসহ হাজী মনিরুজ্জামান মনিরের বিরুদ্ধে ইত্যাকার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বরারই তিনি থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে একটি চাঁদাবাজি মামলায় মনিরকে গ্রেফতার করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।

এরপর জামিনে মুক্ত হয়ে দেশের বাইরে চলে যান। এরপর কাউন্সিলর রাজীবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। আবারও ফিরে আসেন দেশে। নিজের অপরাধের দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলেন গোটা মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকাকে। হয়ে উঠেন ওই দুই এলাকার জলজ্যান্ত ত্রাস।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, মনিরের নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। এ বাহিনীর অন্যতম সদস্য হলেন মনিরের ভগ্নিপতী মাহিন, আকবর ও সুলতান। ইতোপূর্বে মনির বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন জাতীয় হকি দলের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের মহিলা নেত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা।

কেউ তাঁর কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে শাস্তির খড়গ। সম্প্রতি ঢাকা উদ্যানের শেষ মাথায় নদীর পাড়ে ইট, বালু, পাথর ও সিমেন্টের ব্যবসায়ী বরকত উল্লাহকে হুমকি দেন হাজী মনির। এ ঘটনায় ওই ব্যবসায়ী গত ১০ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

এ সাধারণ ডায়েরিতে তিনি অভিযোগ করেন, মনিরুজ্জামান ও তাঁর লোকজন বিভিন্ন সময় গদিঘরের আশপাশে মহড়া দেন এবং তার কর্মচারীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এছাড়া গত ১০ই অক্টোবর রাতে ঢাকা উদ্যানের মেইন গেটে লোহার খুঁটি স্থাপন করে যানচলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং এলাকার লোকজনকে হুমকি ধমকি দেয়।

স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মোহাম্মদপুর, আদাবর, ঢাকা উদ্যানসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, বাড়ি ও জায়গা দখলসহসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় মনিরুজ্জামান মনির ওরফে হাজী মনিরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা করেছেন ভুক্তভোগীরা।

গত সেপ্টেম্বরে বাড়ি দখল ও প্রাণনাশের হুমকি দেয়ায় মো. বিল্লাল হোসেন ও হাজী ইকবাল হোসেনও তাঁর বিরুদ্ধে একই থানায় পৃথক মামলা ও সাধারণ ডায়েরি করেন।

তুরাগ তীরে মনিরের বাগানবাড়ি উচ্ছেদ
তুরাগ নদী দখল করে গাছগাছালি ঘেরা বাগানবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন হাজী মনিরুজ্জামান মনির। চলতি বছরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁর চারতলা এ বাগানবাড়িটি উচ্ছেদ করে বিআইডাব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাহাসে জড়িয়ে পড়েন মনিরের মা সাদিয়া বেগম।

এ বাগানবাড়ি রক্ষা করতে নানাভাবে ওই সময় বিদেশ থেকে তদবির করেন মনির। কিন্তু প্রভাবশালীদের কথায় কান দিয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করা এ অবৈধ স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়।

এসব অভিযোগের বিষয়ে নামধারী আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুজ্জামান মনির ওরফে হাজী মনিরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

কালের আলো/এসআর/এমএইচ