হাসু-কাসু’র সাম্রাজ্যে ‘পিষ্ট’ আওয়ামী লীগ

প্রকাশিতঃ 8:48 am | November 02, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

রাজধানীর আদাবর শেখেরটেক এলাকায় থাকতেন স্থানীয় আদাবর থানা ছাত্রলীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান মশু (২৩)। ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রড ও ইট দিয়ে পিটিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মশিউরের বাবা জুলহাস ব্যাপারী ৮ জনের নাম উল্লেখ করে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

আরও পড়ুন: আদাবরে দুই ভাইয়ের ‘শাসন’, বাস্তবে কত ‘ভয়ঙ্কর’ হাসু-কাসু?

এ হত্যা মামলার আসামি সেলিম ওরফে কসাই সেলিম ওরফে বিয়ার সেলিম ও সাগর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসু ও তাঁর বড় ভাই আবুল কাশেম কাসু’র প্রধান ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। এ হত্যা মামলার বিচার হয়নি আজও। ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে বোবা কান্নার পাষাণভারে স্তব্ধ জুলহাস ব্যাপারী।

নিহত মশিউর রহমান মশু’র মমতাময়ী মায়ের অভিযোগ, ‘রাস্তাঘাটে হাসু-কাসু’র ক্যাডাররা আমাকে দেখলেই হুমকি দেয়। বলে মামলা ওঠা নইলে তোরে মাইরা ফেলমু।’

২০১৩ সালের ১ এপ্রিল সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন বিটিভির পৌর দর্পণ অনুষ্ঠানের নির্মাতা ও পরিচালক শহিদুল ইসলাম। এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় র‌্যাব-১’র হাতে গ্রেফতার হন হাসু-কাসু’র ৭ অনুসারী। এতো গেলো রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের ঘটনা।

আদাবর ও শেখেরটেক এলাকায় জমি, প্লট-ফ্ল্যাট দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা পরিচালনায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ রেহাই মেলে না কারও। দুই ভাই হাসু-কাসু’র প্রতিহিংসার শিকার হয়ে গত এক যুগে হামলা জখমের মুখে পড়েছেন দলটির প্রায় শতাধিক নেতা।

এ বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনে রীতিমতো পিষ্ট দলীয় নেতা-কর্মীরা। অসহনীয় নির্যাতনে টিকতে না পেরে এলাকা ছাড়তেও বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। রাজনৈতিকভাবেও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন কেউ কেউ। মুখে কুলুপ এঁটেছেন সাধারণ নাগরিকরা।

আবার বিভিন্ন সময়ে ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছেন। প্রায় তিন ডজনের বেশি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু মেলেনি প্রতিকার। মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা বরাবরই ‘ঢাল’ হওয়ায় তাদের অপরাধ সাম্রাজ্যের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। ফলে সব সময়ই তাঁরা থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

জমি দখল চাঁদাবাজির সময় কেউ প্রতিবাদ করলেই তাদের উপর চলতো হাসু-কাসুর নির্যাতন

যেন ‘সাক্ষাৎ যমদূত’ দুই ভাই, হাত কাঁপে না মারতে
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, গত এক যুগে সন্ত্রাসের ‘গডফাদার’ বলে পরিচিতি পেয়েছেন আবুল হাসেম হাসু ও আবুল কাশেম কাসু। যে কাউকে মারতে হাত কাঁপে না তাদের। নুন থেকে চুন খসলেই তেড়ে আসেন। কথায় কথায় খুন-গুমের হুমকি দেন। সরিয়ে দেওয়া হয় দুনিয়ার বুক থেকেও। এমন নজিরও আছে বেশ।

সূত্র জানায়, টার্গেট কিলিংয়ে হাসু-কাসু’র সন্ত্রাসীরা কৌশলী পথ অবলম্বন করেন। তাঁর অস্ত্রবাজ ক্যাডাররা ৮ বছর আগে মাথায়, পিঠে ও বুকে গুলি করে হত্যা করে মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়া এলাকার ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুল বাকী মিল্টনকে (৪০)। মূলত এ হত্যাকান্ডের মাধ্যমেই আদাবর-শেখেরটেক এলাকায় নিজেদের অপরাধ সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের কথা জানান দেন দুই ভাই হাসু-কাসু।

হাসু-কাসু’র ক্যাডার বাহিনীর হাতে হামলা ও নির্যাতনের শিকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে কালের আলো। তাদের একজন আদাবর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদ। ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর হাসু-কাসু’র সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করে।

রিয়াজ মাহমুদ কালের আলোকে বলেন, ‘হাসু-কাসু’র অপকর্ম সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীরা আমাকে দু’বার হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। মূলত আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক এঁকেছিল তাঁরা। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে?

টানা ৫ মাসের চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। এ ঘটনায় ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি।’

খলবাজি, হামলা ও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে আ.লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল এই দুই ভাইকে

এ ছাত্রনেতা আরও অভিযোগ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ কারও রেহাই মিলছে না হাসু-কাসু’র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। আদাবরের কমপক্ষে ৫০ জন মানুষকে তাঁরা কুপিয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন দুই ভাই।

আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষের জমি দখল, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে তাঁরা আঙুল ফুলে বটগাছ হয়েছেন। কিন্তু তাদের কখনও আইনের আনতে ব্যর্থ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’

৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমির হোসেনকেও কুপিয়ে জখম করেছিল হাসু-কাসু’র ক্যাডাররা। এ নেতার ভাষ্যমতে, ‘আমাকে হত্যা করতেই হাসু-কাসু তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিল। আমি মামলা করলেও বিচার পাইনি। উল্টো সেই সন্ত্রাসীরা আমাকে বারবার হত্যার হুমকি দিচ্ছে।’

১০০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শাহরুখ জাহান পাপ্পু জানান, হাসু-কাসু’র অপকর্মের প্রতিবাদ করায় তাঁর গাড়ি ভাঙচুর ও মারধর করে হাসুর লোকজন। আদাবর থানা ছাত্রলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রুবেলকে নির্মমভাবে পেটায় হাসুর ক্যাডার বাহিনী।

একইভাবে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি শেখ মো. সিদ্দিকের বাড়িতেও হামলা করে হাসু-কাসু’র ক্যাডাররা। এ বিষয়ে শেখ মো.সিদ্দিক কালের আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের লোকজন হাসু-কাসু’র অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ। তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসীসহ নানা অপরাধ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে।’

সন্তান হত্যার বিচার দাবিতে আদাবর থানা ছাত্রলীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান মশুর পিতা-মাতা

দখলবাজি, হামলা ও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে আ.লীগ থেকে বহিস্কার
রাজধানীর আদাবর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদের ওপর হামলার অভিযোগে আদাবর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতির পদ হারান আবুল কাশেম কাসু ও আবুল হাসেম হাসু।

মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরে বাংলানগর থানা আওয়ামী লীগের এক যৌথ সভায় তাদের বহিস্কার করেন মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরে বাংলানগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদেক খান ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান।

থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সেই জরুরি সভায় হাস ও কাসু’র বিরুদ্ধে দখলবাজি ও সন্ত্রাসীদের লালনপালন, খুন, ডাকাতি, ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের ওপর হামলা, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করা এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়।

কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার, এরপরও আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়েই একের পর এক অপকীর্তির জন্ম দিচ্ছেন দুই ভাই। মহানগর আওয়ামী লীগের জনৈক নেতা তাদের পেছনে কলকাঠি নাড়ায় পদে না থেকেও তাঁরা নিজেদের সাম্রাজ্যে রয়েছেন বহাল তবিয়তে।

কোটি টাকার গাড়িতে রাজকীয়ভাবে চলাফেরা করেন তারা

কী বলছেন কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসু
নিজের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অভিযোগের বিষয়ে ডিএনসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসেম হাসুর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে কালের আলো। তবে তাঁর সাড়াশব্দ মেলেনি। যদিও একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে তিনি বলেছেন, সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’

আবার একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি। আমার বিশাল সম্পত্তি আছে। এনবিআরে এ সংক্রান্ত ফাইলও আছে। চাঁদাবাজি করে আমি এসব করিনি।

তিনি দাবি করেন, ‘আমি নির্বাচিত হয়ে ১০ কাঠা জমি বিক্রি করেছি। আমাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকতে পারে। কারণ আমি কাউন্সিলর। আমার পক্ষে-বিপক্ষে লোক আছে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে। আমি স্বতন্ত্র কাউন্সিলর।

সরকারদলীয় কাউন্সিলর না যে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে না। ছাত্রলীগ নেতা ও মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, তারা নিজেরা মারামারি করে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছে। আর মাদকের সঙ্গে আমি জড়িত নই। এসব পুলিশ, র‌্যাব দেখবে।’

কালের আলো/এমএইচএ/এমএএএমকে