‘অধরা’ আদাবরের অপরাধ সাম্রাজ্যের ‘অলরাউন্ডার’ তুহিন
প্রকাশিতঃ 3:55 pm | November 13, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
রাজধানীর কর্ণফুলী সিটিতে স্বর্ণালংকার ডাকাতির ঘটনার মধ্য দিয়েই উত্থান। বলাবলি আছে, স্বর্ণ লুটের পুরো টাকার ভাগ নিজের পকেটস্থ করতে চোখের পলকে খতম করেছিলেন নিজের ৫ সহযোগীকে। এরপর এক এমপি পুত্রকে ‘বগলদাবা’ করে নাম লেখান আওয়ামী লীগে। জমি-ফ্ল্যাট দখল, চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজিতে তাঁর জুড়ি নেই।
ক্যাসিনো কারবারি হিসেবেও আলোচনায় রয়েছে তাঁর নাম। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বহুল বিতর্কিত এক সাবেক প্রতিমন্ত্রীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন অপরাধ জগত। যুবলীগের একটি থানা কমিটির আহ্বায়ক পদের আড়ালে ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। নিজে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।
চীন, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে পাচার করেছেন সেই টাকা। বলা হচ্ছে, রাজধানীর মোহাম্মদ এলাকার গ্রেফতারকৃত দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজান ও রাজীবের অন্যতম সহযোগী আরিফুর রহমান তুহিনের কথা। স্থানীয়দের কাছে তিনি মাতাব্বর তুহিন হিসেবে পরিচিত।
চলমান সন্ত্রাস ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের পর অপরাধের ‘ষোলকলা’ পূর্ণ করা এ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গাঁঢাকা দিয়েছেন।
ফলে এখন পর্যন্ত ‘অধরা’ রয়েছেন অপরাধ সাম্রাজ্যের এ অলরাউন্ডার। তবে তার রেহাই মেলার কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র। তাঁরা বলছে, তুহিনের অবৈধ কাজকর্মের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।

স্বর্ণলুট করেই ঘটে উত্থান
আদাবরের মাতাব্বর তুহিনের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তুহিনের বাড়ি বরিশাল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দুই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পাগলা মিজান ও তারেকুজ্জামান রাজীবও বৃহত্তর বরিশালের হওয়ায় তাদের সঙ্গে তুহিনের ‘গাঁটছড়া’ পুরনো।
তবে তুহিন প্রথম আলোচনায় আসেন ২০০৪ সালের গোড়ার দিকে রাজধানীর কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির দুটি জুয়েলারি দোকানে স্বর্ণলুটের ঘটনায়।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির সুলতানা জুয়েলার্স থেকে তিন হাজার ৪৭৩ ও মহানগর জুয়েলার্স থেকে দুই হাজার ৪০০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই তুহিন। মূলত স্বর্ণলুটের এ টাকাতেই বদলে যায় তার ভাগ্য। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
ক্রমশ বিস্তৃত হয় অপরাধ সাম্রাজ্য। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকার স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব এবং বহিস্কৃত যুবলীগ নেতা কামরান শহীদ প্রিন্স মহব্বতের সঙ্গে হাত মেলান।

এ সম্পর্কের সূত্র ধরেই অপরাধীদের ‘গডফাদার’ হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার শেল্টার পেয়ে যান। এরপর তাঁর নামের বিপরীতে একাধিক হত্যা মামলা, দখল, চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্যসহ ইত্যাকার অভিযোগ উঠলেও পুলিশ তাকে বাগে আনতে পারেনি।
পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার ধরা পড়লেও ওই বিতর্কিত নেতার আশীর্বাদে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন। সময়, ঘন্টা হিসাব কষেই বেরিয়ে এসেছেন।
একচ্ছত্র আধিপত্য, হত্যাসহ যতো অভিযোগ
রাজধানীর আদাবর এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন আরিফুর রহমান তুহিন। তাঁর বিরুদ্ধে সিলিকন সিটির চাঞ্চল্যকর জোড়া খুন, কাটাসুরের বরকত হত্যাসহ স্বর্ণলুটের ঘটনায় ফাইভ মার্ডার ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা মিরার ভাই ওয়াহিদুজ্জামানসহ একাধিক খুনের অভিযোগ রয়েছে।
এর মধ্যে সিলিকন সিটিতে জোড়া হত্যা মামলার অভিযোগে তুহিন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও দু’দিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে আসেন। একবার ২৩ হাজার পিস ইয়াবা বড়িসহ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি মশিউর তাকে গ্রেফতার করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে আটকে রাখতে পারেননি।
ক্ষমতার অবৈধ প্রভাবে সরকার দলীয় এক সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাকে মুহুর্তেই ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আর তুহিনকে গ্রেফতারের সাহস করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন কর্মকর্তাই। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন পাগলা মিজান-রাজীব সিন্ডিকেটের অন্যতম এ হোতা। তাঁর ভয়ে তটস্থ স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা।

ক্যাসিনো কারবারে সম্পৃক্ততা ও টেন্ডারবাজি
সম্প্রতি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর ক্লাব ব্যবসার আড়ালে ক্যাসিনো বাণিজ্যতেও উঠে আসে মাতাব্বর তুহিনের নাম। রাজধানীর শ্যামলী এলাকার শ্যামলী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তিনি। খেলাধূলার পরিবর্তে সেখানে জুয়ার আসর বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এলজিইডি ভবন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ঢাকা জোনের টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন। গত ১০ বছরে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে পাগলা মিজানের এ সহযোগী কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, কাউন্সিলর পাগলা মিজানের নির্দেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ১৫টি ফার্মের শত কোটি টাকার টেন্ডারের কাগজপত্র ছিনতাই করে নিয়ে যায় তুহিন বাহিনী।
চড়েন পাজারো জিপে, নিয়ন্ত্রণ করেন ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসা
অভাব–অনটনে তুহিনের শৈশব-কৈশোর কাটলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লিখিয়েই যেন আলাদীনের চেরাগ পেয়ে বসেছেন। এ নব্য ‘মহারাজ’ চড়েন দামি পাজারো জিপে। আদাবর এলাকার ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পুরো মোহাম্মদপুর এলাকার মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে অপরাধের সব শাখা-প্রশাখায় তার সদর্প বিচরণ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, তুহিনের রয়েছে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। আর এ বাহিনী এলাকায় ডিশ, ইন্টারনেট ও হাউজিং ব্যবসা পরিচালনা করে। এসব খাত থেকেও মাসওয়ারী লাখ লাখ টাকা চাঁদা উঠে। তার বিহারী স্ত্রী এ অবৈধ কারাবারে সমন্বয় করেন।
তাদের অভিযোগ, তুহিনের ‘দক্ষিণাস্ত’ হিসেবে পরিচিত আদাবর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রুবেল আদাবরে তুহিনের মাদক সাম্রাজ্য দেখভাল করেন। মাদক সম্পৃক্ততায় সম্প্রতি রুবেলের সহযোগী শুভ, রিমন, সাকিব এবং শাহাদাতকে র্যাব গ্রেফতার করে।
জানা যায়নি সেই তুহিনের বক্তব্য
এসব অভিযোগে বিষয়ে আদাবর থানা যুবলীগের আহ্বায়ক আরিফুর রহমান তুহিনের সঙ্গে বারবার কথা বলার চেষ্টা করে কালের আলো। তবে তার সাড়া মেলেনি।
কালের আলো/এএসএম/এমকে