পুশ বাটন সিগন্যালে নিরাপদ সড়ক, ডিএনসিসির উদ্যোগে মিলেছে স্বস্তি
প্রকাশিতঃ 10:32 am | December 26, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে মনোয়ার ইসলাম (৩৫)। নিজ সন্তানকে স্কুলে দিয়ে এদিক সেদিক ছুটোছুটি না করে নিরাপদে সড়ক পার হতে ফুটপাতে স্থাপন করা পুশ বাটন সিগন্যালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাটন পুশ করতেই শুরু হলো কাউন্ট-ডাউন। ২৮ সেকেন্ড জ্বলছে সবুজ রঙের বাতি।
এ সময়টায় কোন গাড়ি চলাচল করছে না। ফলে কোন রকম ঝুঁকি ছাড়াই ফুটপাত সড়কের সঙ্গে সমান করে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেইজড জেব্রা ক্রসিং দিয়ে অনায়েসেই সড়ক পার হলেন। তাকে অনুসরণ করে একইভাবে সড়কে ছুটছেন অন্যান্য পথচারীরাও।
এরপর ১২৭ সেকেন্ড সময় ধরে চলতে থাকছে যানবাহন। নির্দিষ্ট সময় পর যানবাহন থামাতে পুনরায় জ্বলে উঠছে লাল বাতি। মোহাম্মদপুরে আসাদ এভিনিউয়ের গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনের সড়কের এ দৃশ্যটি রোববার (২২ ডিসেম্বর) সকালের। স্থানীয়া বলছেন, এ দৃশ্যটি একদিনের নয় প্রতিদিনের।
বোতাম চেপে সড়ক পারাপারের এ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুশ বাটন টাইম কাউন্ট-ডাউন সিগন্যাল।’ মাত্র মাস দুয়েক আগেও এ পদ্ধতিটির সঙ্গে ইট-পাথরের যান্ত্রিক নগরীর বাসিন্দাদের পরিচয় না থাকলেও এখন দৃশ্যপট বদলেছে।

শৃঙ্খলা ফিরিয়ে সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে এখন এভাবেই উন্নত বিশ্বের পথ ধরে এ পদ্ধতি চালু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। প্রতি ৩ মিনিট পর পর ২৮ সেকেন্ডের জন্য পথচারী পারাপারের সংকেত রয়েছে ডিজিটাল এ পুশ বাটনে। এ ২৮ সেকেন্ড সময় বাজতে থাকবে অ্যালার্ম। এ শব্দ কানে পৌঁছতেই চালকরা গাড়ির গতি কমিয়ে থেমে যাচ্ছেন।
সড়কে মৃত্যুর মিছিল ঠেকানোর পাশাপাশি রাজধানীকে ‘স্মার্ট’ হিসেবে গড়ে তুলতে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের পথেই হেঁটেছেন করপোরেশনের মেয়র মো.আতিকুল ইসলাম। তবে এ আইডিয়াটিকে নিজের নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন গতিশীল ও ছন্দময় ঢাকা গড়ার এ ‘স্বাপ্নিক’।
উত্তরের পরিশ্রমী এ নগর পিতা এ সিগন্যাল উদ্বোধনের দিনেই বলেছিলেন, ‘নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের নানাভাবে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে পুশ বাটন ও জেব্রা ক্রসিংয়ের কথা বলেছেন। লাল-সবুজ বাতির এ আইডিয়াটি প্রধানমন্ত্রীর। আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এটি বাস্তবায়ন করছি।’

অনেকেই বলছেন, ডিজিটাল এ পদ্ধতি ব্যস্ত নগরজীবনকে প্রভাবিত করছে। সড়কে আইন মানার প্রবণতা তৈরি করছে যানবাহন চালক ও পথচারী উভয়েরই। রক্তারক্তির সড়কে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ছেন শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক এমনকি স্কুলের শিক্ষার্থী-অভিভাবকরাও। কেবলমাত্র মোহাম্মদপুর এলাকার একটি সড়কে এ পদ্ধতি চালু হলেও দৃষ্টি কেড়েছে গোটা নগরবাসীর। পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সড়কসমূহে এ পদ্ধতি চালু করার জোর দাবি উঠেছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে সড়ককেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব
রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা এলাকায় দুই বাসের রেষারেষিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী। এ ঘটনার সূত্র ধরে দেশব্যাপী চলে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। রাজধানীতে টানা ৯ দিন রাজপথে অবস্থান নিয়েছিল শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের দাবিমতো সড়ক নিরাপদ করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পুরনো সিস্টেমের বদলে উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতায় ‘পুশ বাটন টাইম কাউন্ট-ডাউন সিগন্যাল’ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে রাজধানীতেও। আর এজন্য প্রথমেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে সড়ককে।

প্রায় দুই মাস আগে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) মোহাম্মদপুরের টাউন হলের পাশে অবস্থিত গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনের সড়কে নির্মিত দেশের প্রথম ‘পুশ বাটন টাইম কাউন্ট-ডাউন সিগনাল’সহ জেব্রা ক্রসিংয়ের উদ্বোধন করেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এরপর মহাখালী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কেও এ সিগন্যাল নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এ দু’টি ডিজিটাল সিগন্যালে খরচা হয়েছে মাত্র সাড়ে ৯ লাখ টাকা। প্রাথমিকভাবে রাজধানীর ৪৮ টি পয়েন্টকে এ সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে করপোরেশন। এর মধ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে ২০ টি পয়েন্টকে, এমন তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
স্পট মোহাম্মদপুর, সরেজমিন সকাল-দুপুর
ডিজিটাল এ সিগন্যাল কেমন কাজে আসছে জানতে চাইলে গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এক শিক্ষার্থী কালের আলোকে বলেন, ‘এ পদ্ধতির ফলে সড়কে পারপারের ঝুঁকি অনেক কমেছে। দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও হ্রাস পেয়েছে।

কোন রকম ঝুঁকি ছাড়াই রাস্তা পারাপারের অভিজ্ঞতায় একই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থী কালের আলোকে বলেন, ‘এ উদ্যোগটি সময়োপযোগী। সহজেই সড়ক পার হওয়া যাচ্ছে। নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে। ভাবতে ভালই লাগছে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ‘পুশ বাটন টাইম কাউন্ট-ডাউন সিগনাল’ পদ্ধতি চালক ও পথচারী উভয়কেই যেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এতে করে সবার মাঝে ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে চালক-পথচারী উভয়কেই আরও সচেতন হতে হবে।’
গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটের ব্যবসায়ী জুলফিকার ইসলাম পার হচ্ছিলেন এ সড়ক। এ প্রতিবেদকও তার সঙ্গেই সড়ক পার হন। এ সময় কথা হয় এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সড়ক নিরাপদ করতে সিটি মেয়র আতিকুল ইসলামের উদ্যোগ ইতিবাচক। এতে দুর্ঘটনার টুটি পুরোপুরি চেপে ধরা সম্ভব। কিন্তু সবার সচেতনতা অপরিহার্য।’

উদ্বোধন করেই দায় সারেননি মেয়র
মেয়র আতিকুল ইসলাম উদ্বোধনের দিনেই বলেছিলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশন থেকে অনেক কাজ করি। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়না। আমি এই স্কুলের অথরিটির কাছে সবিনয় অনুরোধ করবো, তারা যেনো এটাকে রক্ষণাবেক্ষণ করে। স্কুল অথরিটিও আমাদের পুশ বাটন লাইটটি রক্ষণাবেক্ষণের সহযোগিতা করবে বলে আমাকে আশ্বাস দিয়েছে।’
মেয়রের কথা থেকেই স্পষ্ট তিনি কেবলমাত্র উদ্বোধন করেই নিজের দায় এড়িয়ে যাননি। এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল নিশ্চিত করতে ফলোআপও করছেন। পথচারী ও যানবাহন চালকদের লাল-সবুজ অ্যালার্ম মোতাবেক সহায়তা করতে সিটি করপোরেশনের ৪ জন কর্মচারীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। স্থানীয়রা এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল আচরণের প্রশংসা করেছেন।
করপোরেশনের দায়িত্বরত সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম জানান, এখানে ৪ জন গার্ড রয়েছেন। ট্রাফিক আইন মেনে চলতে সহায়তা করতে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। এ কাজে সহায়তাকারী রমজান আলী বলেন, ‘অটো সিস্টেমে সিগন্যাল শেষ হওয়ার পর গাড়ি আটকে দেই। সিগন্যাল শেষ হওয়ার ২৭ সেকেন্ড পর গাড়ি আটকে দিলে পাবলিক আসা যাওয়া করে।’

উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়োজন সুনাগরিক
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাজধানীতে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বসে নেই ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। ‘পুশ বাটন টাইম কাউন্ট-ডাউন সিগনাল’ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের স্বার্থক রূপকার ইসিলয়াস কাঞ্চনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। নিজেরা পথচারী ও যানবাহন চালকের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সেদিন কয়েক ঘন্টা সড়কে অবস্থান নেন।
যে কোন উদ্যোগ বাস্তবায়নে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠার মানসিকতা থাকতে হবে বলে মনে করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই দেশের নাগরিক। তবে আমরা কি সুনাগরিক? সুনাগরিক হতে হলে আমাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু আইন মেনে চলতে হবে।
আইনগুলো যদি আমরা সঠিকভাবে মেনে চলতে পারি, তাহলেই আমরা সুনাগরিক। আমি লক্ষ করেছি কেন যেন এই আইন মানতে জনগণের মধ্যে এক ধরনের অনীহা কাজ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হলে আমাদেরকে অবশ্যই সুনাগরিক হয়ে উঠতে হবে।’
কালের আলো/বিআর/এনএল