‘শ্রমিকগরে শোষণ না কইরা প্রাপ্য মজুরি দিতে অইবো’
প্রকাশিতঃ 10:38 am | May 01, 2018
বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:
শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে রক্তঝরা সংগ্রামের গৌরবময় দিন মহান মে দিবস। কিন্তু এ দিবসের মর্মকথাই জানেন না ইমান আলী সরকার।
তার কাছে মে দিবস মানে জোটবদ্ধ হয়ে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে রাস্তায় মিছিল করা।
নাস্তা-পানি খাওয়া। আবার নিজ কাজে ফিরে যাওয়া। বছর ঘুরে প্রতি বছরই মে দিবস এলেও এ দিবসের মর্মকথা জানা নেই বয়সের সঙ্গে ৫২ বছর যোগ হওয়া ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের এ বাসিন্দার।
১২৭ বছর আগে যে দাবিতে সৃষ্টি হয়েছিল অমর উপাখ্যান সেই মূল চেতনা ইমান আলী না বুঝলেও দৈনিক ১০ ঘণ্টা নিরাপত্তা দেন ময়মনসিংহ নগরীর একটি ব্যাংকের বুথের।
কর্মঘণ্টা হিসেবে তাতে অবশ্য মজুরি জোটে না। নিশ্চয়তা নেই চাকরিরও। তবুও এ কাজ করেই জীবনের গোধূলী বেলায় ৬ সদস্যের ভারী পরিবারের ভার যে বহন করতে পারছেন এতেই সন্তুষ্ট তিনি।
ব্যাংকের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঈদসহ অন্যান্য উৎসবেও তাদের ছুটি মেলে না। মে দিবসের দিনটিতেও তার মতো নিরাপত্তা কর্মীদের অন ডিউটিতেই কাটবে।
এ নিয়েও মোটে আক্ষেপ নেই ইমান আলী সরকারের। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মে দিবসের মর্মবাণী, শ্রমিক-মালিক ঐক্য জানি’ এ বাক্যটিও অজানা যেন তার ভুবনে। অথচ নিজের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে তিনি অধিক মাত্রায় সচেতন।
মে দিবসের কর্মসূচিতে যাবেন কী না জানতে চাইলে সহজ-সরল ভাষায় বলেন, আমরা মে দিবস পালন করলে, ব্যাংকের নিরাপত্তা দেবে কে?’
সোমবার (৩০ এপ্রিল) রাত পৌনে ১২টার দিকে বুথের সামনেই আলাপ হচ্ছিল ইমান আলী সরকারের সঙ্গে। এ সময় আরেক নিরাপত্তা কর্মী ফারুক মিয়া (৩২) তার সঙ্গে ছিলেন।
মহান মে দিবসের মূল চেতনা কাজের নির্দিষ্ট সময় ও উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ- এসব বিষয় তুলে ধরলে ইমান আলী বলতে থাকেন, আমগর কাজের সময় নির্ধারণ করা আছে।
কিন্তু আমাদের কোন ছুটি নাই। সব দিন সমান। আমরা ছুটিতে থাকলে পাবলিক ও রাষ্ট্রের অসুবিধা হতে পারে। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে কোন দুর্ঘটনা বা অঘটন ঘটলে নিজেদের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
প্রতি বছর মে দিবস এলে ইমান আলী দেখেন শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী নিজেদের অধিকার আদায়ে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামে। মাথায় লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করে।
ইমান আলী’রও সেইসব কর্মসূচিতে যেতে মন চায়। কিন্তু দায়িত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠার কথা চিন্তা করে নীরব থাকেন।
ইমান আলী’র মাসিক বেতন নির্দিষ্ট ৪ হাজার ৩শ’ টাকা। এর সঙ্গে ওভারটাইম বাবদ রয়েছে আরো দুই থেকে তিন হাজার টাকা।
নিজের বেলায় শ্রমের ন্যায্যমূল্যের হিসাব-নিকাশ না করলেও ইমান আলী’র দু:খবোধ নিজের প্রতিবন্ধী এক ছেলেকে নিয়ে।
তার নাম জুনাইদ। সবে মাত্র আঠার এর কোঠায় পা রেখেছে। মাস দুয়েক আগে কাজ করতো নগরীর নতুন বাজার এলাকার রোম থ্রি কনফেকশনারীর বেকারিতে।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়ে আর চাকরিতে না ফেরায় ওই কারখানার মালিক তার ছেলের এক মাসের পাওনা বেতন দেয়নি।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতেই আক্ষেপ ঝরে তার কণ্ঠে- ওই বেকারির মালিককে বেতন দিতে কত অনুনয় করলাম। কোন কাজ হয়নি। মে দিবসে আমার একটাই দাবি, শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করা। একই সঙ্গে শ্রমিকদের বঞ্চনারও অবসান চাই।
ইমান আলী সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একই রকম দাবি জানান ফারুক মিয়া (৩৫) নামে আরেক নিরাপত্তা কর্মী। বলেন, শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা অনুযায়ী মায়না (মজুরি) জুটে না। চাকরিরও গ্যারান্টি নেই।
হঠাৎ চাকরি হারালে একজন শ্রমিকের জীবনে নেমে আসে মানবিক বিপর্যয়, এটাও অজানা নেই ফারুকের।
মে দিবসে নিজের দাবি সম্পর্কে আঞ্চলিক ভাষায় ফারুক বলেন, শ্রমিকগরে ঠকান যাইবো না। তাগর শ্রম চুইষাও (চুষে) খাওন যাইবো না। শ্রমিকগরে শোষণ না কইরা প্রাপ্য মজুরি দিতে অইবো।
কালের আলো/এমকে/ওএইচ