প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত সিদ্ধান্তে কুয়েতে সেনা মেডিকেল টিম, বাংলাদেশ-কুয়েত সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়

প্রকাশিতঃ 7:40 pm | April 11, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

বৈশ্বিক মহামারী করোনার ভয়ঙ্কর থাবায় বিশ্বজুড়ে লাখ ছাড়িয়েছে মৃত্যুর মিছিল। ইতালি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছে সবখানেই।

পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত গহীন বনাঞ্চল আমাজানেও হানা দিয়েছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস। ভয়াবহ ছোঁয়াচে এই জীবাণু বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করতে যাচ্ছে মরুর দেশ কুয়েতেও।

তবে আগে থেকেই সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দেশটির সরকার। কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কুয়েত সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ খালিদ আল-খদর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার প্রত্যাশার কথা জানান।
 
সেনাপ্রধান বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করলে মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্ধুপ্রতীম দেশটির আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর সময়োচিত সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যেই সেখানে পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শতাধিক সদস্যের একটি মেডিকেল টিম।

এছাড়া কুয়েত সেনাবাহিনীর প্রতি প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সৌজন্যমূলক উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় মেডিকেল কিট।

বাংলাদেশী সেনাদের বন্দনায় মুখর কুয়েতের গণমাধ্যম
বাংলাদেশ থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নিয়ে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) সকালে কুয়েতে অবতরণ করে কুয়েত বিমান বাহিনীর একটি স্পেশাল কার্গো বিমান। সেখানে পৌঁছে যান ১০০ জনের সেনা মেডিকেল টিমও।

এরপর থেকেই কুয়েতের প্রথম সারির পেশাদার গণমাধ্যমসমূহ ভাসছে বাংলাদেশী সেনাদের বন্দনায়।

আক্ষেপ বা হতাশার এই সময়টিতে বাংলাদেশ সরকারের বিরল ভালোবাসা মরুভূমির দেশটির সবার মাঝেই এখন যেন বয়ে দিচ্ছে অবারিত আনন্দের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস।

দেশটির প্রথম সারির ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই প্রচার করেছে কুয়েতের ডাকে সাড়া দিয়ে আবারও বাংলাদেশ সরকার ও দেশটির সেনাবাহিনীর করোনার ভয়াবহতার মুখেও কুয়েতকে বাঁচানোর লড়াইয়ে সামিল হওয়ার বাস্তব চিত্র।

কান্না আর লাশের মিছিল ঠেকাতে অদম্য মনোবলে সর্বোচ্চ সেবা দিয়েই বাংলাদেশী সেনাদের মেডিকেল টিম মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করেই নিজেদের মেধা ও শ্রম ঢেলে দিবেন।

নিজেরা হয়ে উঠবেন মানবসেবার অগ্নিপরীক্ষায় বীরত্বের নায়কোচিত আদর্শ, এমন আশা জাগানিয়া খবরও প্রকাশিত হয়েছে তাদের গণমাধ্যমসমূহে।  

করোনায় কুয়েতকে চিকিৎসা সহায়তার নেপথ্যে
ইরানোর মতো ভয়ানক পরিস্থিতি এড়ানোর পাশাপাশি করোনার সংক্রমণ রোধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে সার্বিক চিকিৎসা সহযোগিতা প্রত্যাশা করে কুয়েত সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশ সরকারও তাদের নিরাশ করেনি। দ্রুতই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে কুয়েতের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ খালিদ আল-খদর কুয়েতকে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে ফোনে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেন।

পরে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।

সরকার প্রধানের এ নির্দেশনার প্রেক্ষিতেই শুক্রবার (১০ এপ্রিল) কুয়েতে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ১০০ সদস্যের সেনা মেডিকেল টিম পাঠানো হয়েছে। কুয়েত সরকারের নির্দেশে সেখানকার মানুষজনের চিকিৎসাসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করবে তারা।

করোনা মহামারী ঠেকাতে কুয়েতের যতো পদক্ষেপ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের পর কুয়েতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

দেশটিতে এখনও কারও মৃত্যুবরণের কথা শোনা যায়নি। তবে করোনা মহামারী রুখে দিতে কঠোর পদক্ষেপ নেয় দেশটির সরকার।

প্রথমেই দশ দেশের নাগরিকদের কুয়েত প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এরপর সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দুই সপ্তাহের জন্য দেশটিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ঘরবন্দি করতে সচেতনতামূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে সেনাদের কর্মদক্ষতায় খুশি কুয়েত
করোনার কালো থাবা থেকে কুয়েতকে মুক্ত করতে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সেনা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে দেশটিতে দু’টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলা হয়েছে। বাংলাদেশের সেনা চিকিৎসকরা নিজেদের সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটুকু দিয়েই পরিচালনা করছেন এসব কোয়ারেন্টাইন সেন্টার।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, বাংলাদেশী সেনা চিকিৎসকদের কর্মদক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কুয়েতের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ খালিদ আল-খদর।

সেনাপ্রধানের সঙ্গে সম্প্রতি ফোনালাপে এসব সেনা চিকিৎসকদের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, নৈতিক মনোবল ও পেশাদারিত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন কুয়েতের সর্বোচ্চ এ সামরিক কর্মকর্তা।

দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ৩০ বছর
১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পর কুয়েত রক্ষায় দেশটিতে মোতায়েন করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।

অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠনের (ওকেপি) অংশ হিসেবে ইরাকের দখলদারিত্ব থেকে কুয়েত রক্ষায় এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশি সেনারা।

সেই হিসেবে কুয়েতের স্বাধীনতার পুনর্গঠনেরও অংশীদার বাংলাদেশের সাহসী সেনা সদস্যরা।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পারদর্শী ও সাহসী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুনাম কুয়েতের আমীর পরিবারের মুখে মুখে। সাধারণ মানুষও বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ত্যাগ ও তাদের ভূমিকার কথা। বাংলাদেশ ও কুয়েত সরকারের মধ্যে সম্পর্ক অন্য রকম উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছেছে।

বন্ধু রাষ্ট্রের দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস যেমন বেড়েছে তেমনি জোরদার হয়েছে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কও। কুয়েত সরকার ও তাদের সেনাবাহিনী সব সময় তাদের দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান ও আত্নত্যাগ কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই স্মরণ করেন।

উভয় দেশের কল্যাণে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়া বাংলাদেশ ও কুয়েত সেনাবাহিনীর মধ্যকার সুস্পর্ক আরও জোরদার হয় গত বছরের ১১ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কুয়েত সফরের মধ্যে দিয়ে।

চারদিনের সরকারি সেই সফরে সেনাপ্রধান কুয়েতের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ খালিদ আল-খদর’র সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে কুয়েতের শীর্ষ এ সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশকে কুয়েতের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেন।

সূত্র মতে, সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সবিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ওই সফরের আড়াই মাসের মাথায় সুসংবাদ আসে। সেনাপ্রধানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দূয়ার খুলে দেয় কুয়েত সরকার।

তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওকেপি-৯ কন্টিনজেন্টের সদস্য সংখ্যা ২৫০ জন থেকে বেড়ে ৬৩৯ জনে উন্নীত করার বিষয়টি ওই বছরের বৃহস্পতিবার (৩০ মে) অনুমোদন করে এবং শিগগির সেখানে চাহিদা মোতাবেক সেনা পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়।

দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন গর্বিত সেনা সদস্যরা
পারস্য উপসাগরের তীর ঘেষে গড়ে উঠা কুয়েতকে মাইনমুক্ত ও পুনর্গঠনে এখনও নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা।

বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সেখানে সাহসিকতার সাথে ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব পরিমন্ডলে উজ্জ্বল করেছেন গর্বিত সেনাসদস্যরা।

একইভাবে যদি দেশের মিশনগুলোও নিজ নিজ দায়িত্বে এমন প্রশংসনীয় ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতো তবে লাল-সবুজের বাংলাদেশের সুনাম-সুখ্যাতি আরও বাড়তো বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আবারও মানবতার জন্যই বুক চিতিয়ে লড়াই
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো কুয়েতেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত মেডিকেল টিমের সুনাম রয়েছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় কুয়েতের চরম এই দু:সময়েও বাংলাদেশের সেনা চিকিৎসকরা পরিবার, পরিজন, সন্তান-প্রিয়জন সব ভুলে মানবতার জন্যই বুক চিতিয়ে লড়াই করবেন।

কুয়েতের মানুষের জীবন রক্ষায় নিজেদের সমর্পণ করে শক্তি, সাহস ও আশা জাগাবেন তাদের মনে।

পরাজয়ের গ্লানি গায়ে না মেখে বরাবরের মতো এবারও নিজেদের গৌরবদীপ্ত পথচলার ধারবাহিকতায় করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ের হাসি মুখে নিয়েই মানবতার বিজয় কেতন উড়িয়েই দেশে ফিরবেন, এমন প্রত্যাশা সবার।

কালের আলো/এসআর/এমএএএমকে