বাবলি আকন্দের অন্যরকম মানবিক লড়াই
প্রকাশিতঃ 10:00 am | May 13, 2020

নিজস্ব প্রতিবেদক কালের আলো :
‘ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন’ প্ল্যাকার্ড হাতে ছুটছেন একজন নারী। মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস এবং মাথায় মপ ক্যাপ। কখনও খালি গলায় আবার কখনও হ্যান্ডমাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বার্তা দিচ্ছেন।
নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের এই বাসিন্দা স্থানীয ভাটিকাশর, বলাশপুরসহ আশপাশের এলাকার সড়কের অলিগলি, চায়ের দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জমায়েত এড়াতে দিন-রাত এক করে হন্যে হয়েই ছুটেছেন। প্রথম দিকে কাজের কাজ না হলেও দিন গড়াতেই উৎসাহিত-উজ্জীবিত হয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা।
ইতোমধ্যেই তাঁর সঙ্গে যোগ হয়েছেন নিয়মিত-অনিয়মিত ২০ স্বেচ্ছাসেবক। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যরকম মানবিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া বাবলি আকন্দের ‘ডাকে’ সত্যি সত্যিই তারা সাড়া দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের সুরক্ষা ও সচেতনতার জন্য নিজের জীবনবাজি রেখে মাঠে নামা এ নারীকে এখন ভালোবেসেই সবাই নাম দিয়েছেন ‘করোনা আপা’।
হ্যাঁ, নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি দৈনিকের সংবাদকর্মী বাবলি আকন্দই করোনার দাপটের মুখে সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শের পাশাপাশি সচেতনতার সাথে সতর্কতা অবলম্বের পরামর্শ দিয়েই সময়ের ব্যবধানে সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। ফলে পথ চলতেই ‘করোনা আপা’ সম্বোধন যেন হৃদয়ে গেঁথে গেছে বাবলি আকন্দেরও।
নিজ এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে খাবার বা চাল না থাকলেই ডাক পড়ে ‘করোনা আপা’র। তারা ফোন করেন বাবলি আকন্দকে। অসহায় মানুষকে সহায়তার উদ্দেশ্যে বাবলি এই বার্তা পৌঁছে দেন জেলা প্রশাসক, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা সমাজের বিত্তবানদের কাছে।
ব্যস, খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা হচ্ছে নিমিষেই। ফলে করোনার এই সঙ্কটময় মুহুর্তেই রীতিমতো ‘ত্রাতা’র ভূমিকা দেখা মিলেছে এই নারীকে।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় এবং লকডাউন কার্যকরে এলাকা ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করে। বাবলি সেই দলের একজন সক্রিয় সদস্য। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।’

লড়াই শুরু যেভাবে
দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে একজন নারী আক্রান্ত হন গত ৮ মার্চ। এরপর থেকেই একজন নারী হিসেবেই সাধারণ মানুষকে সুরক্ষার বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মী বাবলি আকন্দের মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু কঠিন এই যুদ্ধে সঙ্গী ছাড়া লড়াইয়ের কোন জো’ নেই যেন! নিজের ইচ্ছা পূরণে দ্বারস্থ হলেন বন্ধুদের কাছে। কেউ রাজি আবার কেউ ভয় দেখাচ্ছন।
কিন্তু ‘যদি তোর ডাক শোনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ এ মর্মবাণী বাবলি’র হৃদয়তন্ত্রিতে গাঁথা। সাধারণ সুরক্ষা সামগ্রী পড়ে হ্যান্ড মাইক হাতে নেমে পড়লেন। তার সাহস অনুপ্রাণিত করলো বন্ধুদেরও। মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সেই বন্ধুরাও পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাদের নিয়েই শুরু হলো অন্য রকম এক মানবিক লড়াই।
করোনা প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে মানুষকে সচেতন করতে নিত্যদিন নগরীর ভাটিকাশর, বলাশপুরসহ আশপাশের এলাকার সড়ক, অলিগলি ও বাজারে শুরু করলেন ছুটোছুটি।
বাবলি নিজের মুখেই বলছিলেন, কঠিন এই যুদ্ধে নামার সময়ে পরিবারের সমর্থন পেয়েছি। বাসায় তিন বছর বয়সী সন্তান থাকায় প্রথমে মা সাহস করেননি। কিন্তু আমার আইনজীবী স্বামী পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। মানুষের পাশে দাঁড়াতে আমাকে সব রকমের সহযোগিতা করেছেন।
নিজে যখন যুদ্ধে নেমে গেছেন ঠিক সেই সময়েই একটি সুসংবাদ আসে বাবলি’র কানে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করা হচ্ছে। বাবলি যথারীতি সব নিয়ম কানুন মেনে ফরম পূরণ করেন। হয়ে যান জেলা প্রশাসনের অনুমোদিত ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবী।
সাহস আর ইচ্ছাশক্তির জোরেই
কঠোর প্রতিবন্ধকতা ভেদ করেই করোনা বিরোধী লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করেন গণমাধ্যমকর্মী বাবলি আকন্দ। সেই সময়ের কথা জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘এলাকার সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে যখন রাস্তায় নামলাম তখন অনেকেই দুয়ো ধ্বনি দিতো। এলাকার ছেলেরা আড়াল থেকে ‘করোনা ভাইরাস’ বলে বিদ্রুপও করতো।
এমনকি আমাদের এলাকার মুরব্বীরাও বিষয়টিকে আড় চোখে দেখতে শুরু করলেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি দোকানকে জরিমানা করলে সেই দোকানদারেরাও আমাকে দায়ী করে নালিশও জানিয়েছেন। এসব কর্মকান্ড দেখে আমার কষ্ট হতো।

কঠোর মনোবলের অধিকারী বাবলি বলছিলেন, ‘আমি হাল ছাড়ার মেয়ে না। আমি আমার অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির জোরেই আমার কাজ চালিয়ে গেলাম। এলাকায় ঘুরে ঘুরে দোকানপাট বন্ধ রাখা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে গেলাম।’
সবাই আপন করে নিয়েছেন বাবলিকে
সময় গড়াতেই এলাকার মানুষজন রীতিমতো আপন করে নিয়েছেন বাবলিকে। এখন ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কোন ঘরে ঘরে চাল বা খাবার না থাকলেই তারা প্রথমেই ফোন করেন জেলা প্রশাসনের স্বেচ্ছাসেবী এই নারীকে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাবলীকে ডাকা মানেই সব সমস্যার সমাধান।
বাবলিও তাদের নিরাশ করেন না। অসহায় মানুষের খাবার সঙ্কটের কথা পৌঁছে দেন জেলা প্রশাসক, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা সমাজের বিত্তবানদের কাছে। তারাও যথারীতি সাড়া দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মনের গতি-প্রকৃতিও পরিবর্তন হয়েছে।
এতোদিন বাবলি জানাচ্ছিলেন দু:সময়ের কথা। এখন তাঁর ভালোবাসার ‘করোনা আপা’র স্বার্থক পরিণতির বিষয়টি জানান এভাবে- ‘এক সময় যারা আমাকে দেখলেই দুয়ো ধ্বনি দিতেন এখন তাঁরাই উৎসাহ দিচ্ছেন। কোনো সমস্যায় পড়লেই আমাকে জানাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের বরাদ্দকৃত ত্রাণ ও খাদ্যসহায়তা কাউন্সিলরের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে হতদরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ সহায়তা পেয়ে অনেক খুশি।’
কালের আলো/এনএম