করোনাকালে অন্ত:সত্ত্বা নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি; মুজিববর্ষে ত্রাতার ভূমিকায় সেনাবাহিনী
প্রকাশিতঃ 3:56 pm | July 05, 2020
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়ার স্বপ্ন বুনছেন হাজারো মা। অনাগত সন্তানকে পৃথিবীতে স্বাগত জানাতে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা! কিন্তু করোনাকাল বলেই কীনা চরম চাপের মুখে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা।
নিয়মিত চেকআপের সুযোগ নেই। সরকারি হাসপাতালে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও মিলছে না চিকিৎসা সেবা।
সংক্রমণের ভয়ে রোগী দেখতে অনীহা রয়েছে চিকিৎসকদের। একই আশঙ্কায় অন্ত:সত্ত্বা মায়েরাও হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে সাহস করছেন না।
কোন কোন ক্ষেত্রে আবার চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতেও পদে পদে ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে সন্তানসম্ভাবা নারীদের। এতে করে জরুরি সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
মাতৃত্বের ওপর চরম প্রভাব বিস্তার করা ভয়ঙ্কর মহামারি করোনায় অন্ত:সত্ত্বা নারীদের হাল সময়কার অবহেলার বৃত্ত থেকে বের করে আনার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বাঙালি জাতির চির আরাধ্য পুরুষ, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গর্ভবতী মায়েদের সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েই নিজেদের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ।
মানবতা আর দায়িত্ববোধের অপূর্ব সমন্বয়ে মহামারির এই সময়ে গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাসে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সবার সামনে থেকে যুদ্ধ করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
চরম বিপদের এ সময়টিতে মায়েদের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা সহজেই নিশ্চিত করতেই দেশের প্রতিটি জেলায় মাসব্যাপী চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প পরিচালনা করছে সেনা সদর দপ্তর।
গর্ভবতী মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ভবিষ্যত ব্যবস্থাপনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পরামর্শ সেখান থেকে দেওয়া হচ্ছে।
আগামী ৯ জুলাই পর্যন্ত চলবে এ স্বাস্থ্য সেবা। করোনার পাশাপাশি এসব মেডিকেল ক্যাম্প থেকে রক্ত পরীক্ষাও করা হচ্ছে। মিলছে ভিটামিনসহ যাবতীয় ওষুধ। চিকিৎসা নামের সোনার হরিণের এ জামানায় এসব কিছুই হচ্ছে আবার বিনামূল্যে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনীর মাসব্যাপী গর্ভবতী মায়েদের জন্য চলমান এ বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৯৯ জন সেবা গ্রহণ করেছেন।
৪২ জনের করোনা পরীক্ষাসহ ১ হাজার ৭৭৪ জনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে, এমন তথ্য জানিয়েছে আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
সম্প্রতি সুপার সাইক্লোন আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ মুজিববর্ষে প্রসূতি নারীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের বিষয়ে বলেন, ‘করোনা মহামারিতে আমরা মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি।
এটা চলমান থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে সেনাবাহিনী।’
সেদিন সেনাপ্রধান আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে যারা হাসপাতালে যেতে পারেন না তাদেরকে আমরা চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। চিকিৎসকরাও এ সময় চিকিৎসার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এ সেবা আমরা দিয়ে যাবো এবং প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করবে সেনাবাহিনী।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার শুরুর দিকেই সেনাপ্রধান বুকে সাহস, প্রবল আত্নবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবেলাকে একটি যুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
একজন সৈনিক হিসেবে আমরা অকুষ্ঠচিত্তে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই- ইনশাআল্লাহ্’।
নিজের ১৬ দফার যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক নির্দেশনায় সেনা চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন-‘চলমান করোনা যুদ্ধে সিএমএইচসহ মেডিক্যাল কোরের সকল সদস্যগণ প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
আপনাদের এই সেবা এবং ত্যাগ, দেশ ও সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে। আমরা সবসময় আপনাদের পাশে আছি।’
সূত্র মতে, সংকটাপন্ন রোগী নিয়ে স্বজনেরা যখন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন। নানা হাসপাতাল ঘুরেও মিলছে না জরুরি চিকিৎসা।
হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতেই মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে অহরহই। ঠিক তখন গর্ভবতী মায়েদেরও চিকিৎসা সেবা পেতে পদে পদে ভোগান্তির বিষয়টিও হয়ে উঠে ওপেন সিক্রেট।
সন্তানসম্ভাবা নারীদের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাসে সহজেই তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সময়োপযোগী এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে সেনা সদর দপ্তর। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তাদের নেতৃত্বে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালিত হচ্ছে।
দেশপ্রেমিক সেনা চিকিৎসকরা রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, জয়পুরহাট, সিলেট, বরিশাল, সাভারসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই মেডিক্যাল ক্যাম্প পরিচালনা করে প্রসূতি মায়েদের মুখে অনাবিল হাসি ফুটিয়েছেন।
সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান জানান, করোনাকালীন সময়ে গর্ভবতীয় মায়েরা স্বাস্থ্য সহায়তা পেতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে দেশব্যাপী সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের উদ্যোগে পরিচালিত অন্ত:সত্ত্বা মায়েদের স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনে খুশি গর্ভবতী নারীরা। তারা বলেন, ‘সংক্রমণের ভয়ে চিকিৎসক রোগী দেখছেন না।
কিন্তু এখানে আমাদের সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা একেবারেই ব্যতিক্রম। আন্তরিকতার সঙ্গেই তারা বিনামূল্যে আমাদের ওষুধ থেকে শুরু করে যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়েছেন। এতে আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি।’
সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা ক্যাম্পেইনে অন্ত:সত্ত্বাদের সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং অস্থায়ী ল্যাবে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
এই মাতৃকালীন চিকিৎসাসেবা সেনাবাহিনীর দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ নারী চিকিৎসকদের দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের ব্যবস্থাপনায় শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলায় সেবা পাওয়া গর্ভবতী নারীরা বলছেন, ‘টাকা দিয়েও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা মিলছে না।
তারা চেম্বারে আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন। সেখানে সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত করেছেন।’
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার দু:স্থ ও অসহায় গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিনামূলো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়ে সেনাবাহিনীর ১১ পদাতিক ডিভিশনের মেডিকেল ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘এখানে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি সেনা সদস্যদের নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধও বিতরণ করা হয়েছে।’
সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন জানান, পরীক্ষায় কোন মায়ের যদি শরীরের তাপমাত্রা বেশি হয় এবং তাদের যদি করোনা উপসর্গ থাকে, তাহলে সিএমএইচ-এ পাঠিয়ে করোনা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া অন্যান্য গর্ভবতী মায়েদের স্বাভাবিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশন ও রংপুর এরিয়ার উদ্যোগে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে প্রসূতি নারীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণের কার্যক্রমে এসেছেন কুড়িগ্রাম জেলার কাঁঠালবাড়ি এলাকার মমতাজ বেগম।
সেবা পেয়ে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে কালের আলোকে তিনি বলেন, ‘সেনা চিকিৎসকরা আমাদের জন্য জীবনবাজি রেখেছেন। তারা আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ওষুধ দিয়েছেন। তাদের এ মানবিকতা অনন্য।’
কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে