দরপত্র চূড়ান্ত হলেও আটকে আছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্প

প্রকাশিতঃ 8:14 am | July 13, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমান ‘এয়ারবাস এ৩৮০’ নামবে কক্সবাজার বিমানবন্দরে, এমন স্বপ্ন দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্বপ্নপূরণেই বিশ্ব পরিমন্ডলে সংযোগ স্থাপনে আভ্যন্তরীণ থেকে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত হচ্ছে বিমানবন্দরটি।

আন্তর্জাতিক রুটের সব বিমান যেন কক্সবাজার রুটে উঠানামা করতে পারে সেজন্য ৯ হাজার ফুট রানওয়েকে ১০ হাজার ৭০০ ফুট করা হচ্ছে।

সম্প্রসারিত হতে যাওয়া ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ের ১ হাজার ৩০০ ফুটই থাকবে সাগরের পানির মধ্যে। এজন্য প্রথমবারের মতো সমুদ্রে ব্লক তৈরি করে রানওয়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

দেশের পর্যটন শিল্পে অভাবনীয় সাফল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি একটি পূর্ণাঙ্গ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য সুপরিসর রানওয়ে অপরিহার্য হওয়ায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি দরপত্রও আহবান করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন মেনেই তারা চূড়ান্ত করেছে দরপত্র। সিভিল এভিয়েশন পোস্ট কোয়ালিফিকেশনের মাধ্যমেই সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবেই চীনের ‘সিআরসিসি হার্বারকে’ যোগ্য ঘোষণাও করেছে।

আর এতেই যেন চরম ‘মাথাব্যাথা’ তৈরি হয়েছে কাজ বঞ্চিত এইচডিসি-এনডিই।

দরপত্রে দেওয়া বাজেট থেকে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা কম দর দেওয়া ৩১ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ‘সিআরসিসি হার্বারের যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলেও তাদের নাস্তানুবাদ করতেই একের পর এক অভিযোগের তুবড়ি ছুটাচ্ছে সেই কোম্পানিটি, এমন কথাবার্তা সবার মুখে মুখে।

তবে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সপ্তাহ দুয়েক আগে মন্ত্রণালয়ের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকের পর সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) পাঠানো হয়েছে। এতে করে আটকে আছে প্রধানমন্ত্রীর এ অগ্রাধিকার প্রকল্পটি।

তারা পুরো বিষয়টি চরম সতর্কতার সঙ্গেই খতিয়ে দেখছে আইএমইডি। এ কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হলে ঢাকার পর কক্সবাজারেই হবে দেশের দ্বিতীয় পুর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

জানা যায়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র বন্দর কক্সবাজারে গা ভেজাতে দূর দূরান্ত থেকে ভিড় জমান দেশি-বিদেশী পর্যটকরা। পাহাড়-পর্বতে ঘেরা প্রাকৃতি সৌন্দর্যের পাশাপাশি ব্যবসায়িক কারণেও এ পর্যটন নগরীর গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণে।

সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলেছে এখানকার সমুদ্র অর্থনীতি। এতো কিছুর পরও ব্যবসায়ী, বিদেশী বিনিয়োগকারী কিংবা পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়নি।

বন্ধুপ্রতীম মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক কৌশলগত কারণেও বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে এ বিমানবন্দরটির।

আবার, ভবিষ্যতে কক্সবাজারকে একটি বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি চীনের কুনমিং, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককসহ অনেক শহরের সঙ্গে এ নগরীর সরাসরি যোগাযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠায় কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

সূত্র মতে, ২০১৫ সালের ২ জুলাই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধাানমন্ত্রী। ওই সময় বিমানবন্দরের রানওয়ে ৬ হাজার ৭৭৫ ফুট থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ফুটে উন্নীত করা করা হয়।

২০১৯ সালের রোববার (৯ জুন) গণভবনে ত্রিদেশীয় সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দর নির্মাণ করে বিশ্বমানের পর্যটন এলাকা তৈরির নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানান।

সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কক্সবাজারে যে বিমানবন্দর আছে সেটাকে আরও আধুনিক মানের করা হবে। আপনারা জানেন কক্সবাজার হলো বিশ্বের একটি অন্যতম আন্তর্জাতিক রুট।

এখানকার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের হলে বাইরের বিমানগুলো এখানে ট্রানজিট সুবিধা পাবে এবং বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজার ঘুরে দেখবে।’

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করতে কক্সবাজার বিমানবন্দরের আয়তন তিন দফায় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৭’শ ফুটে উন্নীত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

একই সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে অতি সম্প্রতি কক্সবাজার বিমানবন্দরটির রানওয়ে আরও এক হাজার ৭০০ বর্গফুট বাড়াতে দরপত্র আহ্বান করে বেবিচক। ১০ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। এ দরপত্রের কারিগরি মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় বুয়েটের স্বনামধন্য শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করেন।

বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, দরপত্রে শর্ত পূরণ না করায় ‘এইচডিসি-এনডিই’ এবং ‘সিএইচইসি’ নামের দু’টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। প্রয়োজনীয় সব দলিলপত্র দাখিল করে যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় চীনের ‘সিআরসিসি হার্বারকে’।

মানের প্রশ্নে বেবিচক কোন আপোস না করলেও দরপত্র মূল্যায়নে বাদ পড়া ‘এইচডিসি-এনডিই’ নামের প্রতিষ্ঠানটি দরপত্র চূড়ান্তকরণের সময় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অমান্য করার অভিযোগ করে।

তারা দরপত্রে উত্তীর্ণ সিআরসিসি হার্বারকে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) কালো তালিকাভুক্ত এবং ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার বদলে ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বলে কুৎসাচার করে।

কিন্তু বেবিচক সূত্র বলছে, সিভিল এভিয়েশন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) ২০০৮’র বিধি-৮ মোতাবেক প্রতিটি অভিযোগেরই জবাব দিয়েছে।

পাশাপাশি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিএ) ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) ২০০৮’র বিধি-৮ অমান্যেরও প্রশ্নই উঠে না।

একই সূত্র জানায়, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিআরসিসি হার্বার ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। ২০১১ সালের জুন মাসের দিকে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করা হলেও তাদের অভিজ্ঞতার বয়স ৩১ বছর। দরপত্রের শর্তের চেয়েও তাদের অভিজ্ঞতা ১৬ বছর বেশি।

কালো তালিকাভুক্তির গোয়েবলসীয় অভিযোগের বিষয়েও কথা বলেছেন বেবিচকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ থাকে কোন কোন কোম্পানি দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

কিন্তু সিপিটিউতে কালো তালিকাভুক্ত ৯৫ কোম্পানির মধ্যে চূড়ান্ত হওয়া ওই কোম্পানির কোন নাম নেই।’

সূত্র জানায়, হুন্দাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রেগুলেশন (পিপিআর) মোতাবেক অভিযোগ দাখিলের পর সিভিল এভিয়েশন ঠিকমতোই সেই অভিযোগের জবাব দেয়।

এরপর তারা মন্ত্রণালয়সহ কোথাও আর কোন অভিযোগ দাখিল করেনি। কিন্তু কোম্পানিটির স্থানীয় প্রতিনিধিই গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি ঠেকানোর তৎপরতা শুরু করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

যদিও হুন্দাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধি সারাজান কাজী দাবি করেছেন, ‘হুন্দাইয়ের মতো অভিজ্ঞ একটি কোম্পানি স্যামসাং’র মতো কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিতেছে। এ কোম্পানি সর্বনিম্ন দরপত্র দিয়েও কক্সবাজার রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজটি পায়নি।’

বেবিচক সূত্র জানায়, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের দরপত্র নিয়ে গত ২৫ জুন ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কাজ বঞ্চিত ‘এইচডিসি-এনডিই’র দরপত্র প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) পাঠানো হয়েছে।

সব নিয়ম মেনে দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ওই কোম্পানিকে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান।

কালের আলোকে তিনি বলেন, ‘কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার প্রশ্নই উঠে না।

আমরা যা কিছু করেছি দলিলাদি এবং যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব তথ্য উপস্থাপন করেছে তার ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে। অনেকে দেশের স্বার্থ না দেখে নিজের স্বার্থে নানা রকম প্রপাগান্ডা করে। আমাদের এগুলোর উর্ধ্বে থাকা উচিত।’

জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো.মাহবুব আলী কালের আলোকে বলেন, ‘স্বচ্ছতার সঙ্গেই দরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। নিজেদের স্বার্থহানির জন্যই অনেকেই অনেক রকম অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু আদতে তাদের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই।’

কালের আলো/এমএএএমকে