বঙ্গবন্ধু পকেট থেকে ৩০০ টাকা বের করে দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে!
প্রকাশিতঃ 11:36 am | August 16, 2020

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :
স্কুল জীবনেই ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের। নিজের প্রথম যৌবনেই ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে হয়ে ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি।
আরও পড়ুন: বাঙালির মুক্তিদাতাকে নৃশংসতম হত্যার অশ্রুঝরা দিন
১৯৬৮তে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে কারাবরণ করার ইতিহাস যেমন রয়েছে তেমনি ৭০’র নির্বাচনে প্রথমবারের মতো গনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন বীর সেনানী।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসন থেকে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার একক কৃতিত্বও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
আরও পড়ুন: শোকের উচ্চারণে স্বাধীন ভূখন্ডের চিত্রকর, রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধিদের মর্মস্পর্শী মূল্যায়ন
রাষ্ট্রপতির জ্যেষ্ঠ সন্তান প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকও বাবার পথ অনুসরণ করেই টানা তিনবার সংসদ সদস্য হয়েছেন একই আসন থেকে।
সহজ-সরল আব্দুল হামিদ মহামান্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে ইস্পাত কঠিন চেহারায় যেমন আবির্ভূত হন তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর হিসেবে শিক্ষার্থীদের সামনে স্বভাবসুলভভাবে রসিকতায় ভরপুর বক্তব্য উপস্থাপন করে নিজের জনপ্রিয়তায় অন্যরকম মাত্রা যোগ করেছেন।
আরও পড়ুন: অনিবার্ণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু; সেনাপ্রধানের সারল্য-ঐশ্বর্যমন্ডিত উপস্থাপন

হাওরের সবার প্রিয় এ ‘মহামান্য’ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য। বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করতেন। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের অনেক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী দেখা যায় এ রাষ্ট্রপতির মধ্যে। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই শিখেছেন মানুষকে আপন করে নিতে।
বছর কয়েক আগে একটি জাতীয় দৈনিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ লিখেছিলেন- প্রান্তে নয়, কেন্দ্রেই রাজনৈতিক জীবন শুরু করতে চেয়েছিলাম আমি। ১৯৬৯ সালের কথা।
তখনও কিশোরগঞ্জে ছাত্রলীগ করি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্খায় ঢাকায় চলে এলাম। বিএ পাস করার পর এক ইয়ার লস দিয়ে আইন পড়ব বলে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বঙ্গবন্ধুকে আমার পরিকল্পনা জানাব বলে গেলাম ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে। আমাদের সবার প্রিয় মুজিব ভাই আমার ঢাকায় আসতে চাওয়ায় প্রবল আপত্তি জানালেন। সেই দিনটির কথা আমি আগেও লিখেছি, বলেছিও বহুবার, সভা-সমাবেশ এবং অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়।
এর আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু’বার দেখা হয়েছে আমার। সেটি ছিল তৃতীয়বারের মতো প্রিয় নেতার মুখোমুখি হওয়া। বঙ্গবন্ধু বয়োকনিষ্ঠদের সাধারণত ‘তুই’ করে বলতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘না, তোর ঢাকায় আসা চলবে না। তুই সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি হয়ে কিশোরগঞ্জ চলে যা। সেখানে গিয়ে সংগঠন আর আন্দোলনে মন দে।’ আমার মন খারাপ হলো।
তখন ঢাকায় এসে রাজনীতি করার জন্য ব্যাকুল আমার মন। সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি না হওয়ার জন্য একটু চালাকি করে বলি, ‘বাড়ি থেকে যে টাকা নিয়ে এসেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই তা শেষ হয়ে গেছে, অন্য কোথাও ভর্তি হওয়ার মতো টাকা নেই।’
বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে নিজের পকেট থেকে ৩০০ টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন। সেই সময় ৩০০ টাকা, অনেক টাকা।
রাষ্ট্রপতি লিখেন- ‘বঙ্গবন্ধু যখন আমাকে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি হয়ে কিশোরগঞ্জে ফিরে যেতে বলছিলেন, তখনই সেখানে এসে ঢুকেছেন তোফায়েল আহমেদ।

বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, ‘হামিদকে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে ভর্তি করার ব্যবস্থাটা করে দাও এবং বইপত্র কিনে দিয়ে কিশোরগঞ্জ পাঠানোর ব্যবস্থা করো।’ অগত্যা কী আর করা, কিশোরগঞ্জে ফিরে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার কাজেই মনোনিবেশ করলাম।
তখন তো বুঝতে পারিনি, আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। এখন বুঝতে পারি, তৃণমূলে ফেরার রহস্য। বঙ্গবন্ধু এভাবেই আমাকে শিখিয়েছিলেন জনগণের কাছে যাওয়ার মাহাত্ন্য। আমার নির্বাচনী এলাকা তো বটেই, পুরো কিশোরগঞ্জে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি।
কিশোরগঞ্জের এমন কোনো পাড়া-মহল্লা নেই, যেখানকার মানুষজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। সত্তরের নির্বাচনের সময় আমার নির্বাচনী এলাকা ছিল ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও তাড়াইল নিয়ে। পরে অবশ্য নিকলী ও তাড়াইল আলাদা হয়ে গেছে।
আজকাল হাওরাঞ্চলের ওইসব গ্রাম থেকে যখন তরুণরা আমার কাছে আসে, আমি তাদের পুরনো মানুষের কথা জিজ্ঞেস করি। আলাপে-আলাপে জানা হয়ে যায়, আমার চেনা মানুষটি হয়তো ওই তরুণটির বাবা-চাচা, অথবা নিকটাত্মীয় কেউ।
তরুণ-তরুণীদের কেউ কেউ জানায়, আমার চেনা মানুষটি তার দাদা, ওই মানুষটি এখন আর বেঁচে নেই। মানুষকে নামধামসহ মনে রাখতে পারাটাও আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শিখেছি।
তবে বঙ্গবন্ধুর মতো স্মৃতিধর হতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম দেখা ১৯৬৪ সালে। প্রথম ও দ্বিতীয় দেখার মধ্যে ব্যবধান ছিল বছর তিনেকের এবং দ্বিতীয়বার যখন দেখা হয়, তখন নিমিষেই আমাকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি।
তিনি লিখেছেন- প্রথম দেখা হওয়ার গল্পটাই প্রথমে বলি। সময়টা ছিল ১৯৬৪ সাল। তখন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র আমি। তখনও কিশোরগঞ্জ ছিল মহকুমা এবং আমি মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
মুজিব ভাই ওই সময় কিশোরগঞ্জ আসেন আওয়ামী লীগের সমাবেশে। নেতার সঙ্গে দেখা করা এবং কথা বলার আগ্রহে আমরা দু-তিনশ’ ছাত্রলীগ কর্মী নিয়ে সমাবেশস্থলে গিয়েছিলাম।
আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। আমরাও নাছোড়, বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম, নেতা বের হলে প্রয়োজনে রাস্তার মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করব, কথা বলব।
শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা সফল হয়েছে, আমরা প্রিয় নেতার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলাম সেদিন। তিনি আমাদের উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তায় উদ্দীপ্ত করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ আরো লিখেছিলেন- ‘প্রথমবার দেখা হয়েছিল ভিড়ের মধ্যে। অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মধ্যে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আমি ছিলাম মুখপাত্র।
আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সন্ধ্যার আগে আগে তিনি যখন সমাবেশ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন আমরা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য স্লোগান ধরলাম, ‘মুজিব ভাই যেখানে, আমরা আছি সেখানে।’
বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন, আমরাও সমস্বরে অভিযোগ জানালাম, ‘আমরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসেছিলাম আপনার বক্তৃতা শুনতে; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের হলের ভেতরে ঢুকতে দেননি।’
কালের আলো/এসবি/এমআরকে