এনআরবি ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়, অনুসন্ধানে দুদক

প্রকাশিতঃ 11:56 am | January 21, 2021

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

বেসরকারি খাতের এনআরবি ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে দুদক দুটি আলাদা টিমও গঠন করেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানের কাজও শুরু হয়েছে।

প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্য ও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

দুদক সূত্র জানায়, এনআরবি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার আমিনুর রশিদ খান, তার দুই ছেলে ও ব্যাংকের পরিচালক নাফিহ রশিদ খান এবং নাভিদ রশিদ খান এবং ব্যাংকের আরেক পরিচালক ইদ্রিস ফরায়জীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।

এদিকে ওই টিম গঠনের পরই তারা সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে বিএফআইইউ-এর মহাব্যবস্থাপকের কাছে তথ্য চেয়ে ১৩ জানুয়ারি একটি চিঠি দিয়েছে।

এতে বলা হয়, ‘এনআরবি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার আমিনুর রশিদ খান ও তার দুই ছেলে এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক নাফিহ রশিদ খান ও নাভিদ রশিদ খানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ শেয়ার ক্রয়সহ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

এ অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে উল্লিখিত ব্যক্তি বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে দেশে কিংবা বিদেশের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো চলতি, সঞ্চয়ী, এফডিআর, শেয়ার, লকারসহ অন্যান্য ব্যাংক হিসাব থাকলে সেসবের হিসাববিবরণী এবং কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকলে তার বিশদ বিবরণসহ এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

এ কারণে তাদের নামে হিসাব পাওয়া গেলে হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি প্রোফাইল, টিপি, এনআইডি, পাসপোর্ট, ট্রেড লাইসেন্স, আরজেএসসির নিবন্ধন, টিআইএন সার্টিফিকেট, হিসাববিবরণীসহ সংযুক্ত সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি রেকর্ডপত্রের ফটোকপি ৩০ জানুয়ারির মধ্যে দুদক কার্যালয়ে পাঠাতে হবে।

চিঠিতে আলাদা একটি ফরমে তাদের নাম, পিতা ও মাতার নাম এবং পাসপোর্ট নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চিঠিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-দেশ ট্রেডিং করপোরেশন, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জাব্বার জুট মিলস লিমিটেড, বাংলাদেশ মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড, হাইড্রোকার্বন এবং এম ইশরাত হিমাগার লিমিটেড। এর বাইরে বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামও দেওয়া হয়েছে।

এগুলো হচ্ছে জেনট্রেড এফজেডই (সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং), কমোডিটি ফাস্ট ডিএমসিসি (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) সংযুক্ত আরব আমিরাত ও লোচ শিপিং ইন্টারমিডিয়েটরি এফজেডই (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) সংযুক্ত আরব আমিরাত। নাভিদ রশিদ খান এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক ও অডিট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান।

এনআরবি ব্যাংকের পরিচালকদের বিরুদ্ধে দুদকে যে অভিযোগ জমা পড়েছে, সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক এম বদিউজ্জামানের অন্যতম পার্টনার আমিনুর রশিদ খান। আর দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্রে আমিনুর রশিদ খান একটি পরিচিত এক নাম। বর্তমানে আমিনুর রশিদ খান এনআরবি ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার এবং দুই ছেলে ব্যাংকটির পরিচালক। এম বদিউজ্জামান ও আমিনুর রশিদ খান অত্যন্ত সুকৌশলে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে দুর্নীতি ও নানা অপকর্মের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গিয়েছেন। তারা নানা প্রতারণা করে বছরের পর বছর সরকারের কর ফাঁকি দিয়ে দেশের টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে চলেছেন। তারা মূলত পারবিারিকভাবেই হুন্ডি ব্যবসায়ী।

অভিযোগে আরও বলা হয়, আমিনুর রশিদ খান জামায়াত-বিএনপির আন্তর্জাতিক ডোনার। দুবাইয়ে বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে তার দুই ছেলের। বাংলাদেশেও বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালসহ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে। সার, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের কাঁচামাল আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের কথা বলে এসব কোম্পানি খোলা হয়েছে। তবে এই কোম্পানিকে ব্যবহার করে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছেন তারা। আবার নিজেরাই নিজেদের বাংলাদেশি কোম্পানিতে তাদের নিজস্ব দুবাইয়ের কোম্পানি থেকে এলসি দেখিয়ে শত শত কোটি টাকার ওভার ইনভয়েস করেছেন। আর দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে তার দুই ছেলে ও স্ত্রীর নামে ওয়েজ আর্নার বন্ড কিনেছেন, যা মূলত বাংলাদেশি টাকা।

শুধু তাই নয়, দেশে ও বিদেশে হুন্ডি ব্যবসা চালিয়ে থাকেন আমিনুর রশিদ খান। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে তার হুন্ডি ব্যবসার মূল পার্টনার এনআরবি ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক এম বদিউজ্জামান, তার স্ত্রী নাসরিন জামান ও মেয়ে তানিয়া জামান। আর বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ ও কালো টাকার মালিক ও অর্থ পাচারকারী হলেন এম বদিউজ্জামানের স্ত্রী নাসরিন জামান।

এদিকে, আমিনুর রশিদ খানের আরেক সহযোগী এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক ইদ্রিস ফরায়জী। তিনি আবার ইউরোপের হুন্ডি ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচিত। ইদ্রিস ফরায়জীর মালিকানাধীন ন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ কোম্পানি বৈদেশিক অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু থাকলেও এর আড়ালে মূলত চলে হুন্ডি ব্যবসা। এর মাধ্যমে তারা দেশের বিভিন্ন ঋণখেলাপি ও রাঘববোয়ালদের বড় অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করে কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এছাড়া পপুলার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস নামক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে আদম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইদ্রসি ফরায়জী। তার নিজস্ব এবং নামে-বেনামে সহযোগী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে রয়েছে তার প্রমাণ।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, পারিবারিকভাবেই আমিনুর রশিদ খানের দুই ছেলে নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাদের বয়স যখন ২৫ বছর, তখনই তারা ব্যাংকের পরিচালক নিযুক্ত হন, যে প্রক্রিয়াতে আইন মানা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ধারা ১৫-এর উপধারা ৬ (অ) অনুযায়ী ব্যাংকের পরিচালক হতে হলে কমপক্ষে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। সেই ধারা তো লঙ্ঘন হয়েছেই, এমনকি নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে পরিচালক হিসেবে অনুমোদন না করলেও অবৈধভাবে তাদের পরিচালক পদে বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানকে ইকবাল আহমেদ অভিকে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে সরানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর আমিনুর রশিদ খান ব্যাংকের পরিচালক না হয়েও তার দুই ছেলের পরিচালক হওয়ার সুবাদে নানা অনৈতিক কাজ পরিচালনা করেন এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে দুদকের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে।

এতে বলা হয়েছে, আমিনুর রশিদ খান ও তার দুই ছেলে দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। মিরপুরে ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তাদের একটি বহুতল ভবণ নির্মাণাধীন। কর ফাঁকি দেওয়ার স্বার্থে এই ভবনের তথ্য তিনি ও তার ছেলেরা কেউই আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। এছাড়া অবৈধ টাকায় বিভিন্ন এলাকায় প্লট, ফ্ল্যাট, জমি-জমা ও সম্পত্তিও কিনেছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে এনআরবি ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি ব্যাংকের কোনো বিষয় না। এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। তাই এখানে আমার মন্তব্য করার এখতিয়ার নেই। এ বিষয়ে তিনি ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারির সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে এনআরবি ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি হাসানুল হকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। এমনকি একাধিক মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক বলেন, এনআরবি ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেটি নিয়ে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষ হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। তবে আমরা কাজ করছি। তথ্য পেতে বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারছি না।

কালের আলো/এসবি/এমআরকে