মরণনেশা এলএসডি, বিস্তার ঘটছে দেশে

প্রকাশিতঃ 10:04 am | May 30, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি-কে ‘সাইকাডেলিক’ মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ধরণের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশেপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো ‘হ্যালুসিনেট’ বা অলীক বস্তু দেখে থাকে।

ভয়াবহতার বিচারে এই মাদককে বলা হয়ে থাকে ‘লাস্ট স্টেজ অব ড্রাগ’। ভয়াবহ উদ্বেগের সংবাদ হলেও সত্যি- হেরোইন, কোকেন, খাট, আইস, এনপিএস, ইয়াবার পর এলএসডি নামের এ মরণনেশার বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশেও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের অবৈধ মাদকের বাজারে এলএসডি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ফেসবুকে গ্রুপ ও আইডি খুলে পশ্চিমের ভয়ঙ্কর এ মাদকের বিকিকিনি চলছে। কিন্তু আগে সেভাবে বিষযটি কারও নজরে আসেনি।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের আত্মহননের পরই মূলত নড়েচড়ে বসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গত ১৫ মে রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ধারালো দা নিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলে আত্মঘাতী হন হাফিজুর।

কেন তিনি এভাবে আত্মঘাতী হলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এলএসডি মাদক কারবারের গোপন নেটওয়ার্কের হদিস পান। পুলিশ সূত্র বলছে, এ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয় অনলাইনে। আর মাদকটি নেদারল্যান্ডস থেকে আসে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে।

গোয়েন্দারা জানতে পারেন- ঢাকার বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি এবং গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরি করে তা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে বিক্রি করছে। যার পেমেন্ট নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ; যা রাই এবং বিভিন্ন ধরণের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয়।

এটি স্বচ্ছ ও গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, এলএসডি মাদক গ্রহণের পর সেবীরা মনে মনে ভাবতে থাকেন, যেন আকাশে উড়ছেন! ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পেছনে এই এলএসডি-ই দায়ী।

হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গত বুধবার রাতে ৬ লাখ টাকার ২০০ ব্লট এলএসডি মাদক জব্দ করেছে ডিবি পুলিশের রমনা বিভাগ। এগুলোর প্রতিটি ব্লটের মূল্য ৩-৪ হাজার টাকা। এলএসডি বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নিহত হাফিজুরের বন্ধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ-র ছাত্র সাদমান সাকিব ওরফে রূপল (২৫) ও আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তুর্জ এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফকে (২৩)।

এদিকে হাফিজুরের মৃত্যুর বিষয়ে ২৭ মে দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গত বুধবার বাংলাদেশে প্রথম আমরা এলএসডি উদ্ধার করেছি। এ ঘটনায় ৩ তরুণকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের কাছ থেকে গাঁজার কেক তৈরি ও বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়।

জানা গেছে, ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড’ নামে দুটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সেখানে গাঁজা পাতার নির্যাস দিয়ে কেক তৈরি করে মাদক হিসেবে বিক্রি করতেন তারা। এ গ্রুপে প্রায় এক হাজার সদস্য। তবে কেক মাদক উদ্ধার করা যায়নি।

সাদমান সাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-র বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ (শেষ বর্ষ) পড়াশোনা করছেন। তিনিই মূলত বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের এক নাগরিকের কাছে এ মাদক অর্ডার করেন। নেদারল্যান্ডস থেকে ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে আসা ডাকটিকিটের মতো দেখতে এ মাদকের প্রতিটি ব্লট ৮০০ ও এক হাজার টাকায় কেনা হয়। কুরিয়ার সার্ভিস পার্সেলের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় এটি। ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সাদমানসহ তাদের তিন বন্ধু সেখান থেকে এলএসডি বিক্রি করতেন।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, এলএসডি মাদককে এমডিএমএ, এন, এম-ডাইমথাইলিটিপেনিয়া, সিলোসাইবিন মাশরুমসহ এলএসডি-২৫, অ্যাসিড, ডেলিসিড ইত্যাদি নামে ডাকে সেবীরা। মাদকটি ব্লট আকারে পাওয়া যায়। যা খুব ছোট একটি কাগজের টুকরা সদৃশ মাদকমিশ্রিত বস্তু। তিন ছাত্রের কাছ থেকে উদ্ধার এলএসডিগুলো দেখতে স্ট্যাম্পের মতো। এগুলো যে মাদক তা দেখে বুঝার উপায় নেই। এলএসডি সেবকরা ঠোঁটের নিচে এ এলএসডি রেখে দিত।

‘মাদকগুলো সাধারণত মানবদেহের চিন্তা, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিক চেতনাকে পরিবর্তন করে। সেবনকারীর দৃষ্টি ও শ্রুতির মধ্যে হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়। এটি সেবন করলে চোখের মণির বিকৃতি ঘটে, শরীরের রক্তচাপ ও তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এলএসডি শুধু ক্ষতিকারকই নয়, ব্যয়বহুলও।’

তিনি বলেন, নতুন ও দামি মাদক হওয়ায় গ্রেপ্তার হওয়ারা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতেন।
এক প্রশ্নের উত্তরেন ডিবি পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এটি নিষিদ্ধ মাদক। এমনকি এর ক্রয়-বিক্রয় বাংলাদেশের প্রচলিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

‘এলএসডি মাদকসহ অন্য মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করা হবে। এছাড়া যারা নেদারল্যান্ডস থেকে এ মাদক বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তাদের শনাক্তের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি বিভাগে চিঠি দিয়ে খোঁজ নিতে বলা হবে ‘ যোগ করেন তিনি।

একই সঙ্গে নতুন ভয়ঙ্কর এ ড্রাগের যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে সে লক্ষ্যে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সর্বসাধারণকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান পুলিশ কর্মকর্তা একেএম হাফিজ আক্তার।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, হাফিজের বন্ধুরা বলেছে, তিনি একটি নতুন ও অদ্ভুত মাদকে আসক্ত ছিলেন। এরপরই এলএসডির বিষয়ে তথ্য পেয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তবে আত্মহত্যা করা হাফিজুরের মরদেহের ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে বলে জানান তিনি।

কালের আলো/ডিএসকে/এমএম