অদৃশ্য শত্রুর থাবা শিশুর মনেও

প্রকাশিতঃ 10:02 am | May 31, 2021

জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা, কালের আলো:

রাজধানীর পশ্চিম ধানমণ্ডিতে দুই ছেলেসহ সস্ত্রীক ভাড়া থাকেন বেসরকারি চাকুরে মো. মিলন হোসেন। পরিবারের তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী। পেশায় বেসরকারি সংস্থার মাঠকর্মী মিলনের দুই ছেলেই স্থানীয় রায়ের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র।

মাস শেষে যা আয় হতো তা দিয়েই মিলনদের চারজনের সংসার চলে যেত। কিন্তু গতবছর থেকে শুরু হওয়া করোনায় তিনি নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। গেল ঈদে বোনাসও দেওয়া হয়নি তাকে। এ অবস্থায় পরিবার চালাতে গিয়ে পুরোপুরি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মিলন।

এর মাঝে নিয়মিত খাবার সংস্থানই কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, করোনায় সন্তানদের স্কুল বন্ধ। পড়ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে৷ লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই আগের মতো৷ পুরো সময় কাটছে টিভি দেখে আর মোবাইলে।আচরণে এসেছে পরিবর্তন৷ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার দিতে পারছি না।

এমন পরিস্থিতিতে সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই অভিভাবক।

শুধু মিলনই নয়, করোনায় আয় কমে যাওয়ায় ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সন্তানদের মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অভিভাবকেরা।

মো. সোলায়মান, পেশায় বাসচালক। লকডাউনে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত এপ্রিলে পরিবারকে গ্রামের ভোলায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজে উঠেছেন রায়ের বাজার এলাকার একটি মেসে।

কালের আলোকে তিনি বলেন, দুই মেয়ে এক ছেলে, সবাই স্কুলে পড়াশোনা করে। বড় মেয়ে রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। করোনায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। পুষ্টি তো দূরের কথা নিয়মিত ওদের খাবারই দিতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।

‘ঢাকায় নিয়ে এসে কিংবা গ্রামের স্কুলে যে আবারও ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারবো তা বলতে পারছি না।’

মেয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেয়ে প্রায়ই প্রশ্ন করে, তার স্কুলের সহপাঠী কিংবা শিক্ষকদের সঙ্গে কী আর দেখা হবে না! আদৌ পড়া চালিয়ে যেতে পারবো কিনা—ইত্যাদি।

গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে প্রায় ১৫ মাস ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১২ জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষায় যে ঘাটতি হচ্ছে আগামী বছরেও হয়তো সেটা কাটিয়ে ওঠা যাবে না।

অভিভাবকেরা বলছেন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কাছে যে ধরনের পড়াশোনা হয় সেটা বাসায় হয় না। ক্লাসে ৪৫ মিনিটে শিক্ষার্থীরা যা শিখবে ওই একই বিষয় সে বাসায় শিখতে সক্ষম হচ্ছে না। বড় শহরে কিছু স্কুল অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও গ্রামের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে পাঠদান অনুষ্ঠান হলেও অনেকে তা জানেনই না।

জানা যায়, করোনাকালে গ্রামের শিশুদের স্কুল বন্ধ থাকলেও তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে তেমন পরিবর্তন আসেনি। বলা যায়, তারা ঘরবন্দি নয়। এসব শিশু শুধু স্কুলে গিয়েই পড়াশোনা করতে পারছে না।

তবে অনেক পরিবারে অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষতি হওয়ায় শিশুদের ওপর নতুন এক ধরনের পারিবারিক মানসিক চাপ তৈরি করছে। এতে শিশুদের ঝরে পড়ার হার বাড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি শিশু শ্রম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে। অনেক জায়গায় ঘটছে বাল্য বিবাহের মতো ঘটনা। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হওয়ার খবর অহরহই আসছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমের হার কমেছিল ৯৪ শতাংশ কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এর প্রবণতা উল্টো পথে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। শিশুরা আবারও শিশু শ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হবে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করছে।

অন্যদিকে শহুরে শিশুরা ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছে। ঘরে থাকার কারণে খেলাধুলা বা শরীর চর্চার সুযোগ থাকছে না। এ কারণে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, সার্বিকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে ব্যাঘাত ঘটেছে তাতে আমাদের যারা দরিদ্র ও হত দরিদ্র তাদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে-যা আমরা দেখেছিও এরই মধ্যে। নতুন অনেক পরিবার দারিদ্রের তালিকায় চলে আসছে। পরিবারের সদস্যদের যদি আয় কমে যায় তাহলে ওই উপার্জনক্ষম ব্যক্তির উপর পরিবারের অন্য যারা নির্ভরশীল তাদের পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উপর খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রভাব পড়বে।

বিষয়টার ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, আগে হয়ত বাবা-মা তার শিশুকে সপ্তাহে পাঁচটা ডিম দিতে পারতো। কিন্তু এখন হয়ত একটা বা দুটো দিতে পারে। সব খাবারগুলো আর দিতে পারছে না। এমন ঘটনা কিন্তু ঘটছে।

শিশুর পুষ্টির অভাব, মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত
করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায় বেকারত্ব, দারিদ্র, ক্ষুধাও বেড়েছে। মা-বাবার আয় কমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারও গ্রহণ করতে পারছে না শিশুরা।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রিয়াজ মোবারক কালের আলোকে বলেন, করোনায় অনেকেরই বেতন বন্ধ হয়ে গেছে বা কমে গেছে, চাকরি চলে গেছে। এসব ঘরে তো খাবার ঠিকমতো আসছে না। শিশুর যে সুষম পুষ্টি সেটা কিন্তু হচ্ছে না। সে কারণে শিশুর লম্বায় বড় হওয়া, ওজন বাড়া এসব কমে যাবে।

তিনি বলেন, ঘরে বসে থেকে শিশু একাকীত্বে ভুগছে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।একটা শিশু যখন হাঁটতে শেখে, কথা বলতে, দৌড়াতে শেখে, ছবি আঁকে, নাচে—এইসব জিনিস শিশুর বিকাশের একটা অংশ। শিশুর সকল ধরনের বিকাশ, বুদ্ধির বিকাশ এই পরিস্থিতিতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া শিশুর সময় কাটানোর জন্য আরেকটা শিশুর দরকার হয়। কিন্ত এখন সে সুযোগ পাচ্ছে না।

‘শিশুর পুষ্টির অভাব হলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকবে। আর অন্যদিকে আরেকটি শিশুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ শিশুরা সবচেয়ে বেশি পায় স্কুলে, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের পরিবারে। সেই সুযোগ তার একেবারেই কমে গেছে,’ বলেন ডা. রিশাজ মোবারক।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন বলেন, বিশ্বব্যাপী এই মহামারির মতো এই অবস্থা কখনও হয়নি। যদি হয়েও থাকে এর আগে তা কোনো একটি অঞ্চলে হয়েছে। এবার এই মহামারির শিকার পুরো পৃথিবী। এজন্য মহামারিকালে শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বিশেষ কিছু দায়িত্ব পালনের কথা বলেন তিনি।

তার মতে, শিক্ষ আছে শিশুরা। অভিভাবকরা মাঝে-মধ্যে শিশুদের বাইরে নিয়ে যেতে পারেন। পার্ক অথবা নদীর পাড়ে যেখানে লোকজনের চলাচল কম। তবে অবশ্যই বাইরে বের হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

এদিকে গত ৩ মার্চ ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের মার্চ থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশে। এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হচ্ছে শুধু বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থী।

ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবকটি দেশ করোনার প্রভাব কমার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছিল। তবে পরিস্থিতি খারাপ হলে আবার বন্ধ করা হয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশে টানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। তবে মহামারি নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সংক্রমণ বাড়বে। কারণ ছেলেমেয়ে নিয়ে অভিভাবকেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিড় করবেন। সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব হবে না। স্বাস্থ্যবিধি ব্যাহত হবে।

তিনি বলেন, সরকারের কাছে অনুরোধ করেন যেন, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়। শিক্ষকদের এই প্রযুক্তিতে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে।

কালের আলো/এসএ/বিআরকে