করোনায় ‘নিজস্ব’ পরিবেশে প্রাণীরা, বেড়েছে প্রজনন

প্রকাশিতঃ 2:55 pm | June 12, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব। ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এখনও কমছে না সংক্রমনের হার। তবে এই করোনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায়।

করোনার কারণে চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীদের ভিড় কম। ফলে পশুপাখিরা কোনো দর্শনার্থীর বিরক্তি ছাড়াই ঘুরে বেড়াতে পারছে। মানুষের কোলাহলহীন চিড়িয়াখানায় এখন সতেজ হয়ে উঠেছে গাছপালাও। ফলেছে বিভিন্ন ফল-ফলাদিও।

চিড়িয়াখানায় নিযুক্ত কর্মী মো. রনজু জানালেন, এবার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকার কারণে আম আর কাঁঠালের ফলন ভালো হয়েছে। কেউ চুরি করে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে না। প্রকৃতিও সতেজ।

ঘুরে দেখা গেল, রোদ পোহাতে উপরে আসা জলহস্তীগুলোর বাচ্চারাও মায়ের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত। বিশাল এলাকায় ছুটে বেড়াচ্ছে হরিণ শাবকেরা।

কর্তৃপক্ষ বলছে, কেউ বিরক্ত না করায় প্রাণীদের রোগব্যাধিও কমে গেছে। ফলে প্রজনন ক্ষমতা বেড়েছে। গত দেড় বছরে বেড়েছে প্রায় ২০০ প্রাণী। এটাকে করোনা মহামারির ‘সুফল’ হিসেবে দেখছেন জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। দর্শনার্থী না থাকায় এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ঢেলে সাজানো হচ্ছে চিড়িয়াখানাকে। নেওয়া হয়েছে মাস্টারপ্ল্যান। সেখানে ১৬ কোটি টাকার উন্নয়মূলক কাজ চলছে। সিঙ্গাপুরের আদলে চিড়িয়াখানাকে এখন অনেকটা সাফারি পার্কের রূপ দেওয়া হচ্ছে। হাতিকে শেখানো হচ্ছে ফুটবল খেলা। শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে পার্কের আদলে একটা প্লে জোন। লেক দুটিকে বানানো হচ্ছে নান্দনিক পরিবেশে।

জানা যায়, ১৯৭৪ সালে চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর আগে কখনো প্রাণীরা এত নিরিবিলি থাকার সুযোগ পায়নি। ফলে বহু প্রাণীর ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। এই অতিথিদের নিয়ে খানিকটা বিপাকেও আছে কর্তৃপক্ষ।

বন্যপ্রাণী আইন মেনে হরিণ ও ময়ূর বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০ জন আবেদনও করেছেন কেনার জন্য। শুধু কি বিরক্ত না করার কারণে প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা বেড়েছে?

কর্তৃপক্ষ বলছে, বিরক্ত না করার কারণে তাদের খুব একটা রোগব্যাধিও হচ্ছে না। ফলে প্রাণীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক প্রাণী মানুষের উপস্থিতি বাচ্চা প্রসব করে না, এ সময় জিরাফও বাচ্চা দিয়েছে। দেখতে অনেকটা মুরগির বাচ্চার মতো ময়ূরের ৩৬টি বাচ্চা এখন শেডে যাওয়ার অপেক্ষায়।

বেড়েছে প্রজনন ক্ষমতা 
গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে চিড়িয়াখানা বন্ধ করে দেয়া হয়। সাত মাস ১০ দিন বন্ধ থাকার পর গত নভেম্বর আবারও খোলা হয়। এরপর ২ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয়বার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় লকডাউনে চিড়িয়াখানায় জন্ম নেয় ১১৬টি প্রাণী।

এর মধ্যে জলহস্তী একটা, ইমপালা একটা, কমন ইলেন একটা, জিরাফ একটা, বানরের তিনটা বাচ্চাসহ অনেক প্রাণীর ঘরে নতুন অতিথি আসে। পরে দফায় লকডাউনে আফ্রিকান হর্স দুটা, জেব্রা দুটা, জলহস্তী একটা, ইমুপাখি ১৬টা, ৩৬টা ময়ূরের বাচ্চাসহ ৬২টি নতুন অতিথি আসে। এছাড়া প্রত্যেক সপ্তাহে দুই-তিনটা চিত্রা হরিণ জন্ম নেয়।

এর মূল কারণ এখন কেউ তাদের ডিসটার্ব করে না। কোনো অসুখ নেই। যে সমস্ত বাচ্চা হচ্ছে, তার মধ্যে মৃত্যুর হার একেবারেই নগণ্য। ফলে দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। নতুন অতিথিদের নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।

চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আব্দুল লতীফ বলেন, ‘লোকজনের সমাগম থাকলে প্রাণীরা বিরক্ত হয়। লোকজন না থাকায় খুব আরামে খাবার খাচ্ছে প্রাণীগুলো। ভালো খাবার পাচ্ছে, ইমিউনিটি ভালো আছে, প্রজনন ক্ষমতা অনেক বেড়েছে তাদের। গতবারের লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এরকম পরিস্থিতিতে প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটার ফল আমরা পাব পাঁচ থেকে ছয় মাস পর।’

প্রণয়ন হচ্ছে নতুন মাস্টারপ্ল্যান
চিড়িয়াখানায় ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রাণী বেড়েছে। এ অবস্থায় নতুন মাস্টারপ্ল্যানে চিড়িয়াখানাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মাস্টারপ্ল্যানের কাজ ইতোমধ্যে ৪৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ধাপে ধাপে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলবে। এই পরিকল্পনার আওতায় রাজা বাহাদুর ও সুন্দরী নামের দুইটি হাতিকে ফুটবল খেলা শেখানো হচ্ছে।

এখন তারা দৌড়ে ফুটবল খেলতে পারে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, একদম জঙ্গলের পরিবেশে সাজানো হবে চিড়িয়াখানা। মানুষ যখন প্রাণীর খাঁচার সামনে যাবে তখন কোনো দেয়াল দেখবে না। একদম প্রাকৃতিক মনে হবে। দেয়ালের বদলে থাকবে ইলেকট্রিক ফেন্স। এগুলো এমনভাবে সাজানো থাকবে যে দেখলে মনে হবে অনেকটা জায়গা জুড়ে জঙ্গল আছে। আবার অনেক প্রাণীকে জলাধার দিয়ে পৃথক রাখা হবে।

আব্দুল লতীফ বলেন, বর্তমানে চিড়িয়াখানায় প্রাণীগুলোর এলোমেলো খাঁচাগুলো সুনির্দিষ্ট জোনভিত্তিক করা হচ্ছে। পাঁচটি জোনে থাকবে প্রাণীগুলো। সুন্দরবন কেন্দ্রিক প্রাণীগুলো থাকবে একপাশে, এর নাম হবে বাংলাদেশ হ্যাবিটেট। আফ্রিকান জঙ্গলের প্রাণী জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তীসহ এগুলো থাকবে আরেক জোনে। এর নাম হবে আফ্রিকান হ্যাবিটেট। পেট অ্যানিমেলের আলাদা একটা জোন হবে। নিশাচর প্রাণীদের দেখানোর জন্য দর্শকদের জন্য থাকবে নাইট সাফারির ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য তৈরি হবে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।

চিড়িয়াখানা এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠান
চিড়িয়াখানার পরিচালক আব্দুল লতীফের দাবি, এখন কিন্তু চিড়িয়াখানা লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বাদে প্রতিবছর প্রাণীদের খাবার ও ওষুধসহ আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হয় ১০ থেকে ১১ কোটি টাকার মতো। এখানে ২৬০ জনের মতো স্টাফ আছেন। তবে করোনার সময় ১৭০ জনের মতো কাজ করছেন। টিকিট বিক্রি, বাথরুম ও মিউজিয়াম থেকে আয় বাবদ এখান থেকে আসে ১১ কোটি টাকার মতো। এছাড়া হরিণ ও ময়ূর বিক্রি করেও একটা অর্থ পাওয়া যায়।

এই কর্মকর্তার মতে, এখানে শুধু দিনে নয়, রাতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রতিটি প্রাণীর খাঁচায় খেয়াল রাখতে হয়। এখানকার কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গত বুধবার চিড়িয়াখানা পরিদর্শনের সময় কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলছিলেন, প্রতিনিয়তই তাদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। আগেও দুজন সহকর্মী বাঘ ও ভাল্লুকের থাবায় জীবন দিতে হয়েছে। করোনার মধ্যে চিড়িয়াখানাকে জরুরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করলে এখানে যারা কাজ করেন তাদের কিছুটা আর্থিক সুবিধা মিলত। সবাই কাজেও উত্সাহ পেতেন।

কোন প্রজাতির কত প্রাণী আছে চিড়িয়াখানায়
চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৩৫ প্রজাতির ৩ হাজার ১০০ এর মতো প্রাণী আছে। ১৯৭৪ সালে ১৮৬ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা দেশের সবচেয়ে বড় এই মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা। এখানে মাংসাশী আট প্রজাতির ৩৮টি প্রাণী, ১৯ প্রজাতির বৃহত্ প্রাণী (তৃণভোজী) ২৭১টি, ১৮ প্রজাতির ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ১৯৮টি প্রাণী রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ১০ প্রজাতির সরীসৃপ ৭২টি, ৫৬ প্রজাতির ১ হাজার ১৬২টি পাখি, অ্যাকুরিয়ামে রক্ষিত ১৩৬ প্রজাতির প্রায় আড়াই হাজার মত্স্য। সব মিলিয়ে রয়েছে ১৩৭টি পশুপাখির খাঁচা।

কালের আলো/এসবি/এমএম