মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বিপ্লব, ১০ কোটির বেশি অ্যাকাউন্ট

প্রকাশিতঃ 10:02 am | June 17, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলোঃ

শান্তু বেগম, বয়স চল্লিশের কোটায়, গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। তবে এখন থাকছেন ঢাকার বাড্ডা এলাকার আলীর মোড় এলাকায়। এখানকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন তিনি।

বিধবা শান্তুর তিন কোলে রয়েছে শুধু মা। বিয়ের দুই বছর স্বামী মারা গেলে তিনি আর বিয়ে করেননি। বৃদ্ধা মাকে নিয়েই থাকছেন তিনি। মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। তাই প্রতিমাসেই বেতনের টাকা পাওয়া পর মাকে পাঠিয়ে দেন প্রয়োজনীয় অর্থ। আর এই অর্থ মায়ের কাছে পাঠান মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে।

শান্তুর ভাষ্য, ‘আগে আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে মায়ের কাছে টাকা পাঠাতাম। এমনও সময় গেছে, খুব জরুরি সময়েও টাকা পাঠাতে পারিনি। এখন নিজের মোবাইল থেকে মুহূর্তেই মায়ের মোবাইলে টাকা পাঠাই।’

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে এই আর্থিক সেবার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। তবে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির কাছাকাছি। ১২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের দেশে এ সংখ্যা কোনোভাবেই কম বলার উপায় নেই। ব্যাংকে না গিয়ে দৈনন্দিন ছোট ছোট নানা প্রয়োজনে মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছে। ছোটখাটো লেনদেনে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং।

বিশেষ করে নানা ধরনের পরিষেবা বিল (বিদ্যু, ওয়াসা, গ্যাস, টেলিফোন) পরিশোধ, স্কুল-কলেজের বেতন, অনলাইনে কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, পেনশন, বাস ট্রেন থেকে শুরু করে প্লেনের টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন অনুদান, সাহায্য ইত্যাদি প্রদানে এখন খুব সহজেই মোবাইল আর্থিক সেবার কথা ভাবছে সবাই।

বর্তমানে দ্রুত ব্যাংক হিসাব থেকে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে টাকা আনা সম্ভব হচ্ছে। আবার মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব থেকেও ব্যাংকে টাকা জমা করা যাচ্ছে। এতে ব্যাংকে যাওয়ার ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না মানুষকে।

বিদেশ থেকেও দেশে স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। কবিতা বেগমের স্বামী সাইদুল হক থাকেন সৌদি আরবে। প্রতি মাসে দেশে তিনি টাকা পাঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। কবিতা বেগম বলেন, ‘আগে ৩-৪ মাস পর পর ডাকযোগে স্বামীর টাকা পাঠাতেন। তখন সাংসারিক খরচ মেটাতে সমস্যা হতো। এখন মোবাইল ব্যাংকিং থাকায় প্রতি মাসের টাকা প্রতিমাসেই পাই।’

জানা গেছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা ৫ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুধু টাকা পাঠানো বা উঠানো নয়, কেনাকাটা, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতনভাতা বিতরণ, সরকারি অনুদানপ্রাপ্তি, মোবাইলে তাৎক্ষণিক ব্যালান্স রিচার্জসহ বিভিন্ন সেবা এখন হাতের মুঠোয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্রিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১১ সালের মার্চে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথমবারের মতো দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে।

দেশের সরকারি-বেসরকারি ৫৮টি ব্যাংকের মধ্যে ২৮টি ব্যাংককে এই সেবা চালুর অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ২০টি ব্যাংক সেবাটি চালু করতে পারলেও পরবর্তী সময় চারটি ব্যাংক সেবাটি বন্ধ করে দেয়। ফলে বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা ব্যাংকের সংখ্যা ১৬টিতে নেমে এসেছে।

এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’ এবং সরকারি ডাক ব্যবস্থায় পরিচালিক ‘নগদ’ এ সেবায় এগিয়ে রয়েছে। নতুন এসেছে ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘উপায়’।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমএফএস লেনদেনের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক তার এ্যাকাউন্টে দিনে পাঁচবারে ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন বা জমা করতে পারবেন। মাসে ২৫ বার সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ক্যাশ ইন করা যায়। আগে প্রতিদিন দুবারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা জমা করতে পারতেন একজন গ্রাহক। মাসে ২০ বারে এক লাখ টাকা ক্যাশ ইন করতে পারতেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে ৮ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এগুলো হলো- ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স, ক্যাশ-ইন ট্রানজেকশন, ক্যাশ আউট ট্রানজেকশন, পিটুপি ট্রানজেকশন, বেতন বিতরণ (বিটুবি), ইউটিলিটি বিল (পিটুবি), মার্চেন্ট লেনদেন ও সরকারী বিভিন্ন বিল পরিশোধ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নতুন নতুন সেবা যুক্ত হচ্ছে। এজন্য সক্রিয় হিসাবও বাড়ছে।

উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা এখন বিকাশে টাকা পাঠাতে পারছেন। বিকাশ এ্যাপ ও ব্যাংকগুলোর অনলাইন ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নতুন এ সেবা নিতে পারছেন ব্যাংকের গ্রাহকরা।

বর্তমানে সারাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখের বেশি বিকাশ গ্রাহক রয়েছে জানিয়ে শামসুদ্দিন ডালিম বলেন, বিকাশ অ্যাপ থেকে পল্লী বিদ্যুৎ, নেসকো, ডেসকো প্রিপেইড এবং বিটিসিএলসহ আরও নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানের ফি পরিশোধ করা যাচ্ছে। এছাড়া বিকাশ থেকে যখন তখন মোবাইল রিচার্জ, সব ধরনের বিল পরিশোধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছেন গ্রাহকরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। খুব অল্প সময়ে ৮ কোটি গ্রাহক বিস্ময়ের বিষয়।
‘সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকিং চ্যানেল এখন অনেক সজাগ। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ওপর। এ ক্ষেত্রে যেসব আইন রয়েছে তার পরিপালন নিয়ে কাজ করছি আমরা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।’

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি-এর অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যাদের লক্ষ্য করে এই ব্যাংকিংয়ের কথা বলা হচ্ছে অর্থাৎ অল্প আয়ের মানুষ এবং স্বাভাবিকভাবেই স্বল্পশিক্ষিত মানুষের আওতায় ব্যাংকিং সেবায় আসতে পারে অনায়াসেই।

তিনি বলেন, ব্যাংকের শাখা খুলে মানুষকে আর্থিক সেবার আওতায় আনা ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়। যা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজে এরং স্বল্প খরচেই সম্ভব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, দরিদ্র ও ব্যাংকিং সেবাবহির্ভূত জনগণকে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে এবং প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ দ্রুত, সহজ ও নিরাপদে গ্রামীণ এলাকায় বসবাসরত উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য ২০১০ সালে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের কার্যক্রম শুরু করা হয়।

‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে তফসিলি ব্যাংকগুলো। যার ফলে আজ মোবাইল ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা নতুন মাত্রা ছুঁয়েছে,’ বলেন তিনি।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ঝঁকি ও প্রতারণা এড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা:

মোবাইল ফোন থাকলেই যে কেউ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন আর টাকা লেনদেন করতে পারেন বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে। কাউকে ব্যাংকের শাখায় যেতে হয় না। মোবাইল ফোনের কল রিচার্জ বা ‘ফ্লেক্সিলোড’ করেন যারা, তারাই অ্যাকাউন্ট খুলে দেন, ব্যাংকের হয়ে তারাই টাকা-পয়সা লেনদেন করেন।

মোবাইল ফোন নম্বরটিই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নম্বর। এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেই অন্য কোন মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারেন তিনি। নগদ টাকা তুলতে মাঝখানে থাকেন একজন এজেন্ট। তারা মূলত ছোট ব্যবসায়ী, যারা নিজের দোকান-ঘরেই লাইসেন্স নিয়ে থাকেন ব্যাংকের কাছ থেকে। অর্থাৎ মোবাইল ব্যাংকিং মানুষের সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে, কমিয়েছে ভোগান্তি।

এ কারণেই এ পদ্ধতি এত দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। তবে যারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করেন, তাদের বেশিরভাগেরই নিজেদের কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। তারা এজেন্টদের মাধ্যমেই টাকা লেনদেন করেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় ঝুঁকি ও প্রতারণার শিকার হন গ্রাহকেরা। এ বিষয়ে সবার আগে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কালের আলো/এনএল/এমএ