প্রস্তুত হচ্ছে পদ্মাসেতু, উদ্বোধনের দিনই চলবে ট্রেন
প্রকাশিতঃ 10:08 am | June 18, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন দৃশ্যমান। এখন চলছে মূল সেতুর সঙ্গে সংযোগ সেতু বা উড়ালপথে (ভায়াডাক্ট) রেলিং বসানোর কাজ। আগামী বছরের জুনে পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে যান চলাচল শুরুর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে কর্মযজ্ঞ।
সম্প্রতি সরেজমিনে সেতুর প্রকল্প এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, এখন কাজ অতি সামান্যই বাকি রয়েছে। ‘ফিনিশিং টাচ’ দেওয়ার কাজ চলছে এখন।
গত ১ জুন পর্যন্ত সেতুর কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল সেতুর দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে বসানো হয়েছে দুই হাজার ৬৫২টি। অর্থাৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯১ শতাংশ।
বাকি আছে ২৬৫টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ। দুই হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে বসানো হয়েছে দুই হাজার ৯৪৫টি। অর্থাৎ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৯ শতাংশ। বাকি আছে ১৪টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ।
আর ৮৪টি রেলওয়ে আই গার্ডার বা রেলিংয়ের মধ্যে সবই বসানো হয়েছে। ৪৩৮টি সুপার গার্ডারের মধ্যে সব বসে গেছে।
এ পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯৩.৫০ শতাংশ। আর প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এই অগ্রগতি বিবেচনায় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোলে আগামী জুনে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হবে। একই দিন ট্রেন চালুরও লক্ষ্য আছে।
তারা বলেছেন, সেতুর কাজ এগিয়ে নিতে দিনরাত এক করে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। গত ঈদের দিনও তারা আট ঘণ্টা কাজ করেছেন। কর্মকর্তারাও কেউ ছুটি নেন না।
মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি
পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের ভায়াডাক্ট অর্থাৎ সংযোগ সেতুর দৈর্ঘ্য ৩.৬৭ কিলোমিটার। এক্ষেত্রে সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.৮২ কিলোমিটার। সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত মিশেছে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকায়।
উত্তর প্রান্তে সেতু শুরু হয়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া এলাকা থেকে। গত ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর সর্বশেষ বা ৪১তম স্টিলের স্প্যান জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে মূল সেতুর পুরোটা দৃশ্যমান হয়।
দ্বিতল বিশিষ্ট পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। এখন সেতু পারাপারের জন্য কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া দিয়ে সড়ক ও রেলপথ তৈরি হচ্ছে।
মূল সেতুকে মাটির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য দুই প্রান্তে রয়েছে ভায়াডাক্ট। দুই প্রান্তে দুই ভাগ হয়ে এই ভায়াডাক্ট মিশেছে সংযোগ সড়কের সঙ্গে। একটি ভায়াডাক্ট দিয়ে যানবাহন মূল সেতুতে উঠবে এবং অন্যটি দিয়ে নেমে যাবে।
দুই প্রান্তে সড়ক সেতুর দুটি ভায়াডাক্টের মাঝখান দিয়ে ট্রেন মূল সেতুতে ওঠা-নামার জন্য থাকবে আরেকটি ভায়াডাক্ট।
জানা গেছে, মূল সেতুর কাঠামো তৈরি করতে মোট ৪১টি ট্রাস বা স্প্যান ব্যবহৃত হয়েছে। এই স্প্যানের ওপর দুই হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। জুনের হিসাব অনুযায়ী, ২৬৫টি স্ল্যাব বসানোর কাজ বাকি আছে। পাঁচ হাজার ৮৩৪টি শেয়ার পকেটের মধ্যে বাকি রয়েছে ৮১২টি।
মূল সেতু ও ভায়াডাক্ট মিলে রোডওয়েতে মোট ১২ হাজার ৩৯০টি প্যারাপেট ওয়াল বা রেলিং বসানো হবে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৯১টি বসানো হয়েছে। অর্থাৎ বাকি আছে ৮৫ শতাংশ কাজ। রোডওয়েতে পানি নিরোধক একটি স্তর (ওয়াটার প্রুফ মেমব্রেন) বসানো হবে।
এর ওপর সিমেন্ট ও পিচ ঢালাই হবে। পানি নিরোধন স্তর স্থাপনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। সেতুর নিরাপত্তা এলাকায় এই স্তর বসানোর পরীক্ষামূলক কাজ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন পেলে এই স্তর বসানোর কাজ শুরু হবে।
এখনো সড়ক বাতি লাগানোর কাজ শুরু হয়নি। বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজও বাকি। পদ্মাসেতুতে ৫০০ কেভিএ বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। সেতুতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে দুটি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, জাতীয় গ্রিড থেকে ওই সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের বলেন, ‘কর্মপরিকল্পনা অনুসারে আগামী বছর ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সেতুর বিদ্যুৎ সংযোগ ও বাতি লাগানোর কাজ সম্পন্ন সম্ভব হবে। রেলিংসহ অন্যান্য যে কাজ বাকি রয়েছে সেগুলো আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং জুনের মধ্যে সেতুর কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
‘জুন মাসেই পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে,’ যোগ করেন তিনি।
তবে সেতুতে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী আশাবাদী, ২০২২ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ ঘোষিত জুন মাসের দুই মাস আগেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
জানা যায়, পদ্মাসেতু সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার একটি বৃহৎ প্রকল্প। নিজশ্ব অর্থায়নে করা এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ১ জুন পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার ২৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়ে গেলে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সেতুতে রেল ট্র্যাকও বসানো শুরু হবে। এ পর্যন্ত মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৬৬ শতাংশ।
আর বড় সেতু, ভায়াডাক্ট ৩-এর পিয়ার ও বাঁধ (এমব্যাংকমেন্ট), স্প্যান বসানো, কালভার্ট ও আন্ডারপাসের কাজ প্রায় শেষের পথে। আর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের নির্মাণকাজের অগ্রগতি ২৫ শতাংশ।
জানা যায়, ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ১৮ হাজার ২১০ কোটি ১১ লাখ টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক।
প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকাভুক্ত করা হয়। তিন ভাগে বিভক্ত প্রকল্পের কাজ হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া, মাওয়া-ভাঙ্গা ও ভাঙ্গা-যশোর অংশে।
এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া ও ভাঙ্গা-যশোর অংশের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সাল। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি)। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট (সিএসসি) কাজ করছে।
কালের আলো/বিএস/এমএমকে