বেপরোয়া ১৭ গ্যাং, জড়িত ৩৬৪ কিশোর
প্রকাশিতঃ 10:17 am | June 20, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলোঃ
রাজধানীতে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ‘কিশোর গ্যাং’। ভিন্ন ভিন্ন নামে সব নামে এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তুলছে উঠতি বয়সী কিশোরেরা। রাজধানীতে বর্তমানে ১৭টি কিশোর গ্যাংয়ের ৩৬৪ সদস্য সক্রিয় আছে। তাদের সংশ্লিষ্টতা যোগ হওয়ায় সন্ত্রাসী গ্রুপের তৎপরতা ভয়াবহ ও বেপরোয়া রূপ নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ‘হিরোইজম’ দেখাতে গিয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনায় যখন তখন যত্রতত্র অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে হামলে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। পাড়া-মহল্লা-বস্তির ছিঁচকে অপরাধী থেকে শুরু করে ধনীর দুলাল, এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্যাংবাজির সঙ্গে। এসব কিশোরের হাতে হাতে দেশি ও অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি।
সূত্র বলছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডিএমপির মাসিক অপরাধ সভায় রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সভায় কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয় ওসিদের।
এগুলো হলো—
ঢাকা মহানগরের সকল থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে মোবাইল প্যাট্রল, ফুট প্যাট্রল বৃদ্ধিসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে সকল বিভাগে কর্মরত সকল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি), জোনাল এসি, এসি প্যাট্রল ও এডিসিদের সমন্বয়ে পালাক্রমে তদারকি করতে হবে; কিশোর বা শিশুদের গ্যাংবাজির ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট বিট অফিসারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং সোশ্যাল প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিংয়ে গুরুত্ব দিতে হবে; কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে;
অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করতে হবে এবং উঠান বৈঠকে সন্তানদের বিপথগামিতার কারণ উল্লেখ করে সচেতন করতে হবে; বিট রেজিস্টারে এন্ট্রি দিতে হবে;
অহেতুক কিশোররা একত্রে ঘোরাঘুরি বা আড্ডা দিতে না পারে সে জন্য আড্ডা দেওয়ার স্থান চিহ্নিত করে পুলিশ টহল জোরদার করতে হবে; কিশোর গ্যাংদের পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদারদের চিহ্নিত করতে হবে; যদি কোনো সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী কিংবা প্রভাবশালী কারও সন্ধান পাওয়া যায়, তা হলে ব্যবস্থা নিতে হবে;
অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, সশস্ত্র গ্যাং চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে; কিশোর অপরাধ সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে হবে; সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি বাড়াতে হবে;
কিশোর গ্যাংয়ের সন্দেহভাজনদের তথ্যসমূহ এন্ট্রি করতে হবে এবং আলোচিত কিশোর গ্যাং সংক্রান্ত ঘটনাসমূহ ফিকশন বা অপরাধ জার্নালে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে হবে ক্রাইম বিভাগ ও মিডিয়া পিআর বিভাগকে।
সভায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি বলেন, আমাদের মূল দায়িত্ব অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। অপরাধের শিকার কারা হচ্ছে, কখন হচ্ছে এবং কী কারণে হচ্ছে—এসব সঠিকভাবে নির্ণয় করা। ঢাকা শহরের অপরাধ প্রতিরোধে সবাইকে আরও নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। কিশোর অপরাধীর পাশাপাশি গামছা পার্টি, সালাম পার্টি ও টানা পার্টির অপরাধ নিরসনে আমাদের আরও সচেতন থাকতে হবে।
‘নগরবাসীকে সচেতন করার পাশাপাশি থানার মোবাইল টিম ও চেক পোস্ট ডিউটি বৃদ্ধি করতে হবে।’
তথ্য বলছে, রাজধানীর রমনা, লালবাগ, ওয়ারী, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরায় এখন সক্রিয় রয়েছে ১৭টি কিশোর গ্যাং। এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৩৬৪। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ডিএমপির বিভিন্ন থানায় কিশোর গ্যাং সংক্রান্তে মামলা হয়েছে ৫৬টি।
আর চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের গত ৫ মাস ১৫ দিনে কিশোর অপরাধকেন্দ্রিক মামলার সংখ্যা ১০টি। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম মামলা হয় ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি (নম্বর ৬২)। আর কিশোর গ্য্যাংয়ের বিরুদ্ধে সর্বশেষ মামলা হয় চলতি বছরের ১৮ মে (শাহাবাগ থানা মামলা নং-১৭)।
পুুলিশের তথ্যানুযায়ী কিশোর গ্যাংগুলো হলো : রমনায়— বেইলী কিং/রন/রন, আকাশ, বিকাশ, লাভলেন, বাংলা, ফাহাদ, ইয়াছিন গ্রুপ ও আলামিন গ্রুপ। এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৭১। লালবাগের ইয়ামিন ও ফেরদৌস গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১৬ জন।
মতিঝিলের চান জাদু গ্রুপ ও ব্যান্ডেজ গ্রুপে রয়েছে ৩২ জন। তেজগাঁওয়ের রবিন গ্রুপের সংখ্যা ৮। গুলশানের শফিকুল গ্রুপে রয়েছে ৪ জন। মিরপুরের রবিন গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ এবং রাজধানীতে গ্যাং কালচারে সবচেয়ে বেশি ১৫৪ সদস্য নিয়ে বিগ বস ও নিউ নাইন স্টার গ্রুপ গড়ে উঠেছে উত্তরার।
এই কিশোর গ্যাংগুলোর সদস্যদের টার্গেট করে তাদের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের বিষয়ে পুলিশ নজরদারি করতে নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।
জানা গেছে, ডিএমপির তালিকাভুক্ত ১৭ কিশোর গ্যাং ছাড়াও রাজধানীতে সক্রিয় রয়েছে আরও অসংখ্য কিশোর গ্রুপ। সেগুলো হলো—মোহাম্মদপুরের ‘পাটোয়ারী গ্রুপ’, ‘আতঙ্ক গ্রুপ’ ‘চাপায়-দে গ্রুপ’, ‘ফিল্ম-ঝিরঝির গ্রুপ’, ‘লারা-দে গ্রুপ’ ‘গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ’, ‘লেভেল হাই’, ‘দেখে ল-চিনে ল’ ও ‘কোপাইয়া দে গ্রুপ’; উত্তরায় ‘পাওয়ার বয়েজ’, ‘নাইন স্টার’, ‘বিগ বস’, ‘নাইন এম এম বয়েজ’, ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘রনো’, ‘এনএনএস’, ‘ক্যাকরা’, ‘ডিএইচবি’, ‘জিইউ’, ‘এফএইচবি’, ‘ফিফটিন গ্যাং’, ‘ব্লাক রোজ’, ‘কেনাইন’, ‘ডিসকো বয়েস’, ‘পোঁটলা বাবু’, ‘আলতাফ জিরো’, ‘ক্যাসল বয়েজ’, ‘ভাইপার’, ‘সুজন ফাইটার’, ‘তুফান’, ‘থ্রি গোল গ্যাং’ অন্যতম। এ ছাড়া ধানমন্ডির ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ, ‘একে ৪৭’ ও ‘নাইন এম এম’ গ্রুপ; রায়েরবাজার এলাকার ‘মোল্লা রাব্বি গ্রুপ’ ও ‘স্টার বন্ড গ্রুপ’; মিরপুর-১১ এলাকায় ‘বিহারি রাসেল গ্যাং’; মিরপুর ১২ নম্বরে ‘বিচ্ছু বাহিনী’, ‘পিচ্চি বাবু’ ও ‘সাইফুলের গ্যাং’; সি-ব্লকে ‘সাব্বির গ্যাং’; ডি-ব্লকে ‘বাবু-রাজন গ্যাং’; ধ-ব্লকে ‘মোবারক গ্যাং’; মিরপুরের চ-ব্লকে ‘রিপন গ্যাং’; হাজারীবাগে ‘বাংলা গ্যাং’ ও গে-ারিয়ায় ‘লাভলেট গ্যাং’; তেজগাঁওয়ে ‘মাঈনুদ্দিন গ্রুপ’; চকবাজারে ‘টিকটক গ্যাং’, ‘পোঁটলা সিফাত গ্যাং’; তুরাগে ‘তালাচাবি গ্যাং’; কাফরুলের ইব্রাহিমপুরে ‘নয়ন গ্যাং’; দক্ষিণখানে ‘শাহীন-রিপন গ্যাং’; উত্তরখানের বড়বাগের ‘নাজিমউদ্দিন গ্যাং’; আটিপাড়ার ‘শান্ত গ্যাং’ ‘মেহেদী গ্যাং’; খ্রিস্টানপাড়ার ‘সোলেমান গ্যাং’; ট্রান্সমিটার মোড়ের ‘রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং’; মুগদায় ‘চান-জাদু’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ম টু’ ও ‘ভান্ডারি গ্যাং’; এবং বংশালে ‘জুম্মন গ্যাং’ উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা অন্তত এক হাজার হবে। তাদের অনেকেই বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জালে ধরা পড়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ ঠেকাতে রাজধানীতে প্রোঅ্যাকটিভ পুলিশিং করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওসিদের। আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে শুধু মামলা বা গ্রেপ্তার করে তাদের নিবৃত করা দুরূহ বিষয়। তাই আমরা মাঠ পুলিশকে নজরদারি করতে বলেছি।
‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সুপথে আনতে আমরা উঠান বৈঠকসহ মোটিভেশনার অন্যান্য কাজে জোর দিচ্ছি। এ কাজে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অভিভাবকদেরও সম্পৃক্ত করতে মাঠ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,’ বলেন তিনি।
কালের আলো/বিএস/এনএল