শিক্ষক বনাম সম্রাট, প্রশ্ন বনাম বেয়াদবি

প্রকাশিতঃ 11:02 pm | October 05, 2018

অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ:

যে শিক্ষকের ক্লাসে প্রশ্ন করা যায় না, তিনি শিক্ষক নন– সম্রাট; তাঁর হয়তো হবার কথা ছিল প্রাচীন মিশরের ‘ফারাও’, মারাত্মক প্রাকৃতিক ভুলে তিনি হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; কেননা ‘প্রশ্ন করা’কে তিনি বা তাঁরা মনে করেন ‘বেয়াদবি’; এই ফারাও বা সম্রাটরা চান প্রশ্নহীন আনুগত্য, তেলতেলে ও গদগদ ভক্তি। কিন্তু ‘প্রশ্ন করা’র মতন ‘বেয়াদবি’ ছাড়া কখনো কি জ্ঞান উৎপন্ন হয়? দুর্ভাগ্যজনকভাবে সম্রাটসুলভ শিক্ষক আমিও পেয়েছিলাম।

এক সিকি-অধ্যাপক আমাদের ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ পড়াতেন; কিছুই পড়তেন না, ক্লাসে বসে আমরা শুনতাম ‘আওয়ামী লীগের ইতিহাস’ এবং রাজনৈতিক হম্বিতম্বি। আরেকবার বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ পড়াতে এলেন তিনি; ক্লাসের সবাইকে ভূতুড়ে একটি প্রশ্ন করলেন, ‘বুদ্ধদেব বসুর ‘শার্ল বোদলেয়ার ও তাঁর কবিতা’ প্রবন্ধের শিল্পমূল্য কী? বলো তো দেখি।’ এই প্রশ্ন করে সবাইকে অপদস্ত করতে থাকলেন। আমাকে অপদস্ত করার সময় বললাম, ‘আমি জানি না। শিল্পমূল্য বিষয়টা বুঝি না। আপনি যদি স্যার একটু বলেন ভালো হয়। প্রবন্ধের শিল্পমূল্য বলতে কী বুঝায় স্যার?’ অন্য সব দিনের মতো তিনি সেদিনও পড়ে আসেননি। ফলে তিনি ঘামছিলেন। সেই ক্লাসের কিছু দিন পর জানতে পারলাম, আমি বেয়াদব এবং তাঁকে দেখলে সালাম দেই না। আমিও তাই জ্ঞানত তাঁকে সালাম দেয়া বন্ধ করে দিলাম।

উল্লেখ্য, এই ফারাও একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, ‘Teaching profession is just like prostitution. তোমরা আসবা, চাইবা, আমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সেবা করব, তোমরা চলে যাবা। এর বাইরে কিছু নাই। কীসের জ্ঞান, কীসের কী!’ এই ‘জ্ঞানে’র কথাটা চিরকাল আমার মনে থাকবে।

আরেক ষোল-আনা অধ্যাপককে প্রশ্ন করলে বলতেন, ‘এই ছেলে তুমি এতো কথা বল কেন?’ একদিন তিনবার ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন আমাকে। আমার মতো ‘গুড লিসনার’কে প্রায় বাচালের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন তিনি।

আরেক দুর্ধর্ষ ষোল-আনা অধ্যাপককে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগই পাওয়া যেত না অতিশয় যান্ত্রিকতার কারণে, আর সুযোগ পেলেও– ‘আমরা এটা পরের ক্লাসে জানবো।’-– এই উত্তরটিই পেয়েছিলাম দুই বছর ধরে এবং আমাদের প্রশ্নগুলো অনন্ত কালের উদ্দেশ্যে মহাবৈশ্বিক ব্ল্যাকহোলের ভেতর হারিয়ে গেছে।

ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমটা খুব খারাপ; যদিও ঢের টাকা পাবো। কিন্তু আমার অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। দুঃখ লাগে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি আমার সামনে থেকে ধীরে ধীরে কীভাবে খসে পড়ছিল সে-সব মনে পড়ে। এই যে, ছেলেমেয়েরা অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, ভর্তি হবে, তারপর? ‘গণহতাশা’ চেপে ধরবে। র‌্যাগিং, হলে সিট নেই, রাজনীতি। ক্লাস না-হওয়া। সকালের ক্লাস দুপুরে হওয়া। গণহতাশা আমাকেও ঘিরে ধরেছিল। কোনো কোনো কোর্সে ক্লাস হয়েছিল বছরে ৩-৪টা। সর্বোচ্চ ১০-১২টা। কিন্তু পরীক্ষা দিতে হয়েছে, পাস করতে হয়েছে।

এখন কি খুব বদলেছে। বদলায়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাসের জন্য ছাত্রছাত্রীরা অপেক্ষা করে। স্লাইড রেডি নেই। কারেন্ট চলে গেছে। প্রজেক্টর নষ্ট। অমুক দায়িত্ব। তমুক কমিটি। প্রশাসন। হ্যানাত্যানা।

আর এসেছে ইভিনিং ও উইকেন্ড। সেই পড়ুয়াদের জন্যে আছে বাহারি বিজ্ঞাপন — ‘কী পড়িয়া কী করিতে পারিবেন?’, ‘কী সুবিধা পাইবেন?’ কিন্তু নিয়মিতভাবে বার্ষিক ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো বিজ্ঞাপন নাই — ‘কী পড়িয়া কী করিবেন?’, ‘কীভাবে ক্যারিয়ার গড়িবেন?’, ‘গাড়িঘোড়া চড়িবেন?’ রেগুলার স্টুডেন্টদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ওয়াদা নাই। তাই নিয়মিত ক্লাস নেয়ার, পরীক্ষা ও ফলাফল দেয়ার তোরজোড় নাই। ক্লাস মিস হলে ‘মেইক আপ ক্লাস’ও নাই। কিন্তু বাণিজ্যিক কোর্সসমূহে সব আছে। ‘খ্যাপ মারা’র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব আছে।

একটা অংক করতে ইচ্ছা করছে। ধরা যাক, সাকল্যে একজন ষোল-আনা অধ্যাপকের মাসিক বেতন ১ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। তাহার বার্ষিক বেতন ১৩ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। ধরা যাক, উৎসব ভাতাবাবদ পান আরও ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। ভাতাসহ তাহার বার্ষিক প্রাপ্তি ১৫ লক্ষ ৩০ হাজার। তিনি বছরে ১২টি ক্লাস লইয়া থাকিলে তাহার প্রতি লেকচারের মূল্য কত?

উত্তর : ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৫ শত টাকা মাত্র

এই সব মহামূল্যবান অধ্যাপক লইয়া জাতি কী করিবে? ইহারাই আবার ‘‘প্রশ্ন করা’’কে বেয়াদবি বলিয়া ঠাহর করিয়া থাকেন।

যাই হোক, আগের কথায় ফিরে আসি, প্রশ্নই জ্ঞানের উৎস। শিক্ষাদানের সঙ্গে প্রশ্ন করা ও উত্তর প্রাপ্তির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। সম্রাটের আভিজাত্য নিয়ে যাঁরা ক্লাসরুমে যান তাঁদের আসলে যাওয়া উচিত রাজসভায়— পূর্ণ থাকবেন প্রশ্নহীন স্তাবকতায়। কিন্তু জ্ঞানের ঝোঁক যে ‘বেয়াদবি’র দিকেই, অর্থাৎ প্রশ্ন করার দিকেই। তাই ‘বেয়াদবি’র জয় হোক।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।