অবৈধ আইপি টিভির ছড়াছড়ি, ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য!

প্রকাশিতঃ 5:19 pm | July 31, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

সাংবাদিকদের বলা হয়ে থাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর এ চতুর্থ স্তম্ভই এখন বিপাকে পড়েছে নামধারী অবৈধ সাংবাদিকদের জন্য। এজন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে অনুমোদনহীন আইপি টিভি, অনলাইন টিভি বা কথিত অনলাইন পোর্টালকে।

এসব ভূইফোড় প্রতিষ্ঠানের কার্ড নিয়ে ‘হঠাৎ সাংবাদিক’ বনে যাওয়া একশ্রেণির চাঁদাবাজরা রীতিমতো কলঙ্কিত করছে মহান এ পেশাকে।

জানা যায়, রাজধানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও গড়ে উঠেছে আইপি টিভি। কথিত এসব টেলিভিশন চ্যানেল খুলে করা হয় নিয়োগ-বাণিজ্য। কার্ড দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয় সাংবাদিক নামধারী চাঁদাবাজ। এদের দাপটে বিপাকে পড়তে হয় প্রকৃত সাংবাদিকদের।

সম্প্রতি বিতর্কিত নারী হেলেনা জাহাঙ্গীরের অবৈধ আইপি টিভি জয়যাত্রার অফিসে র‌্যাব অভিযান চালানোর পর অবৈধ সব আইপি টিভির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। দাবি উঠেছে অন্যান্য ভূইফোঁড় আইপি টিভির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও।

খোদ রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামপর্যায়ে ভুয়া সাংবাদিক, ফেসবুক সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, দলবাজ সাংবাদিক, টোয়েন্টিফোর ডটকম মার্কার সাংবাদিক-সম্পাদক, আইপি টিভি, ফেসবুক লাইভ সাংবাদিকসহ আরও কতশত পদ-পদবির সাংবাদিকের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ।

দিনরাত উন্মাদের মতো ছোটাছুটির মধ্যেই অবিরাম তাদের ধান্ধাবাজি চালানোর অভিযোগ রয়েছে। সকাল হলে জাতীয় প্রেসক্লাবে কিংবা বিভিন্ন ব্যাংক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় এসব ভুয়া সাংবাদিককে। এতে করে বিপাকে পড়েন প্রকৃত সাংবাদিকরা।

কে আসল, কে নকল, কে ভুয়া তা নিয়ে যাচাই-বাছাই করার মতো শ্রম দেয়ার সময় নেই সাধারণ মানুষের। মাঝেমধ্যে র‌্যাবের হাতে ভুয়া সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, প্রতারক সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার হন। তবুও থেমে নেই সাংবাদিকরা। তাদের দিন শুরু চাঁদাবাজি দিয়েই সাংবাদিকদের মতো তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হন বুম কিংবা ক্যামেরা নিয়ে। বোঝার কোনো উপায় নেই যে কে নকল, আর কে আসল।

জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুক খুলেই যেমন খুশি তেমনভাবে তৈরি করা টোয়েন্টিফোর ডটকমযুক্ত রং-বেরঙের কথিত নিউজ পোর্টালগুলো রীতিমতো ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ওয়ান ম্যান ওয়ান পোর্টাল; প্রত্যেকেই এডিটর এমন স্লোগানকে আদর্শ বানিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক নিউজ পোর্টালগুলো সবার কাছেই আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোয় সকালে একজনের সম্মান ক্ষয় করে, আবার সন্ধ্যা না পেরোতেই চিহ্নিত সিঁধেল চোরাকে বানিয়ে দেয়া হয় সাদা মনের মানুষ।

জানা গেছে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার অনুমোদনহীন টিভি চ্যানেল বন্ধের নির্দেশ দেয়া হলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরে চলছে বেশ কয়েকটি অবৈধ টিভি চ্যানেল।

সূত্র বলছে, এসব চ্যানেলে মূলত বাংলা ছবি ও অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। অবৈধ সম্প্রচারের মাধ্যমে এসব টিভি চ্যানেল বিজ্ঞাপন থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ভারতীয় কয়েকটি টিভি চ্যানেলের লোগাে নকল করেও একাধিক ক্যাবল নেটওয়ার্কে যৌন উত্তেজক ওষুধের অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ ধরনের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ এবং অনুমােদনহীন টিভি বন্ধের প্রশাসনিক দায়িত্ব বিটিভির। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিটিভির মহাপরিচালকের কাছে বার বার চিঠি দেয়া হলেও এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অন্যদিকে বিটিভি সূত্র জানায়, বিটিভির বর্তমান কাঠামাে এবং স্বল্প জনবল নিয়ে অনুমােদনহীন টিভি সম্প্রচার বন্ধে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। পৃথক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছাড়া অবৈধ সম্প্রচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কাছেই অনুমােদনহীন টিভির তালিকা রয়েছে। এসব আইপি টিভি কীভাবে পরিচালিত হয়, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তা জানেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিটিভিকে তিন দফা চিঠি দেয়া হয়েছে অনুমােদহীন টিভি মুভি বাংলা, আনন্দ বাংলা, চ্যানেল-৭, এসবি টিভি (স্বাধীন বাংলা) এবং ঘড়ি ও এমবি লােগাে সংবলিত টিভি চ্যানেল বন্ধের জন্য।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে এসব টিভি চ্যানেল জরুরি ভিত্তিতে বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

সূত্র জানায়, এসব টিভি মূলত ঘরােয়াভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কম্পিউটার থেকে সম্প্রচারের জন্য ভিডিওচিত্র ইসরাইলে ফ্রি স্যাটেলাইট স্টেশনে পাঠানাে হয়। সেখান থেকে স্যাটেলাইটে পাঠানাে হয়। বাংলাদেশে কিছু ক্যাবল অপারেটর ডাউনলিংক করে এসব টিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। চ্যানেল-১৬ এর বিষয়ে অনুসন্ধান করে গিয়ে বের হয়ে আসে এর সঙ্গে জড়িতরাই কখনাে এমবি, কখনাে মুভি বাংলা এবং অন্যান্য নামে অবৈধ টিভি চালিয়ে আসছেন। তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কে এসব অবৈধ চ্যানেল সম্প্রচার করা হচ্ছে। এসব চ্যানেলে বাংলা ছবি, কখনাে যৌন উত্তেজক মিউজিক ভিডিও এবং হােমিও ও আয়ুর্বেদ ওষুধের অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়।

এ বিষয়ে কোয়াবের সাবেক সভাপতি আনােয়ার পারভেজ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত কোনাে ক্যাবল নেটওয়ার্কে এ ধরনের অবৈধ টিভি সম্প্রচার করা হয় না। ছােট ছােট কিছু পকেট নেটওয়ার্ক আছে, যেখান থেকে এগুলাে সম্প্রচারিত হতে পারে।’

তিনি আরাে বলেন, ‘লাইসেন্স এবং সম্প্রচারের বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া তাদের নেটওয়ার্কে কোনাে টিভি সংযুক্ত করা হয় না।

একাধিক সূত্র বলছে, অবৈধ টিভি সম্প্রচারের পাশাপাশি ভারতীয় জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের লােগাে নকল করেও রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কে ‘শক্তি প্রাস’, ‘লাভ ফরএভার’ প্রভৃতি নামে যৌন উত্তেজক ওষুধের অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে অবাধে।

রাজধানীর মিরপুর, রামপুরা, বাড্ডা, খিলক্ষেত, মােহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত ক্যাবল নেটওয়ার্কে এসব পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার হতে দেখা গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাত সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা এবং সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দুই দফায় ভারতের জিবাংলা, সনি-৮, জলসা মুভিজ এবং কালার বাংলার লােগাে নকল করে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে।

ক্যাবল অপারেটর সূত্র বলছে, আগে ভারতের টিভি চ্যানেলগুলােয়ই এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতাে। সম্প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ ধরনের বেশকিছু বিজ্ঞাপন সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর এসব ওষুধের ভারতীয় উৎপাদকরা বাংলাদেশে কিছু এজেন্ট বসিয়ে তাদের মাধ্যমে কিছু অসাধু ক্যাবল টিভির প্রাইভেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অশ্লীল বিজ্ঞাপন প্রচার করছে।

এ দিকে প্রশ্ন উঠেছে এসব নিয়ন্ত্রণে বিটিভির সামর্থ্য নিয়ে। আইনানুযায়ী অবৈধ ও অনুমােদনহীন আইপি টিভির সম্প্রচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব বিটিভির। তবে বাস্তবে বিটিভি এ ধরনের কোনাে ব্যবস্থা নেয়ার সামর্থ্যই রাখে না।

বিটিভি সূত্র জানায়, আইন করা হয় যখন শুধু বিটিভি এবং বেশকিছু বিদেশি চ্যানেল ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কে সম্প্রচার করা হতাে। এখন দেশেই অনেক টিভি চ্যানেল হয়েছে। বর্তমানে বিটিভি অন্যান্য চ্যানেলের মতাে একটি চ্যানেল। এ কারণে বিটিভির সেই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের তাগিদই আর নেই। তাছাড়া জেলাপর্যায়ে অবৈধ আইপি টিভিসহ অনুমােদনহীন বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে অভিযানে জেলা প্রশাসক ও পুলিশের সহায়তা নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসন থেকে সহায়তা পাওয়া যায় না।

জয়যাত্রা টিভি প্রসঙ্গে র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট নাদির শাহ বলেন, জয়যাত্রা আইপি টিভির সব ধরনের সেটআপ থাকলেও এ চ্যানেলের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।

অবৈধ আইপি টিভির বিষয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বলেন, আইপি টিভি ব্যাঙের মতো গজিয়ে উঠেছে। এসব টিভির নাম ব্যবহার করে কার্ড ঝুলিয়ে তথাকথিত সাংবাদিকরা চাঁদাবাজি করছেন।

অবৈধ আইপি টিভির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেন, কিছু আইপি টিভি গুজব রটায় অসত্য তথ্য পরিবেশন করে ও ভাঁড়ামোয় লিপ্ত। নিয়মনীতিহীন এসব টিভির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কালের আলো/ডিএসকে/এমএইচএ